চন্দ্রা, ১৩ বছর বয়সী মেয়ে
চন্দ্রার জীবনের কথা
চন্দ্রা সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটা কারখানায় ট্রাউজার আর পোশাক তৈরি করে। ঈদের আগে সে সেখানে সপ্তাহের প্রত্যেক দিনই কাজ করে, কারণ এখন হল পিক সিজন।
চন্দ্রা একটা ভবনে অথবা ‘বাড়িতে’ থাকে, সেখানে অনেকগুলি ছোট ছোট ইউনিট অথবা ‘ঘর’ আছে, যেখানে অনেকগুলি পরিবার বাস করে। চন্দ্রাদের ভবনে খুব ভিড় আর সেটি খুব নোংরা। ভবনটি দুর্গন্ধময়, অন্ধকার আর সংকীর্ণ। ১৩টি পরিবার এই ভবনটিতে বাস করে। তাদের সবাইয়ের ব্যবহারের জন্য একটি মাত্র নোংরা গোসলখানা, বাসনপত্র আর জামাকাপড় ধোয়ার জায়গা আর একটি রান্নাঘর আছে, যেখানে মাটির চুলায় রান্না করা হয়।
এই ভবনের ছোট একটি ঘরে চন্দ্রা তার বাবা, মা আর দুই বোনের সঙ্গে থাকে। ঘরটিতে একটা বড় খাট, একটা অব্যবহৃত স্টোভ, Wi-Fi-এর সঙ্গে সংযুক্ত একটা TV আর কয়েকটা শেলফ আছে। জামাকাপড় দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
পরিবারের সঙ্গে চন্দ্রা ৬ বছর ধরে এই ঘরটাতে বাস করছে। কাজের জন্য তারা ঢাকায় এসেছে। গত বছর চন্দ্রার মাকে একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়েছিল, ফলে তার পা ভেঙে গিয়েছে। তারপর থেকে তিনি আর কাজ করতে পারেননি।
চন্দ্রার মাকে একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়েছিল, তাই তিনি এখন আর কাজ করতে পারেন না।
“পরিচিত কোনও লোক আশে পাশে না থাকলে রাতে ওভারটাইম কাজ করে নিরাপদ নয়। সেই সময় মাত্র অল্প কয়েকজন কাজ করেন, বিশেষ করে খুব অল্প মহিলারা কাজ করেন। যদি সেখানে আরও মেয়েরা থাকত, তাহলে আমি স্বস্তিতে কাজ করতে পারতাম।”
একজন ক্রুদ্ধ সুপারভাইজার চন্দ্রকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন
২০২৩ সালের ১৬ই মার্চ তারিখে বাড়ি থেকে কাজের জায়গায় যাওয়ার সময়ে চন্দ্রার সঙ্গে একজন CLARISSA গবেষক ছিলেন।
সেই দিনটি ছিল চন্দ্রার সাধারণ একটি দিন, শুধু তফাৎ ছিল যে একজন CLARISSA গবেষক সঙ্গে থাকার কারণে কারখানার মালিকের সঙ্গে চন্দ্রার বচসা হয়, ফলে সকালবেলায় তাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়। যদিও কিছুক্ষণ আলোচনা করার পরে চন্দ্রা আবার কাজে ফিরতে পারে, তবে দিনের বাকি সময়ে মালিক আর তার বন্ধুদের সঙ্গে সময়টা ভাল যায়নি।
রিক্সা চালিয়ে চন্দ্রার বাবা পরিবারের সহায়তা করার মতো যথেষ্ট উপার্জন করতে পারেন না, বস্তুত, তার সম্পূর্ণ উপার্জনই ব্যয় হয় ঋণ পরিশোধ করতে, তাই চন্দ্রা এখন কাজ করছে। বাড়িতে থাকা সন্তানদের মধ্যে চন্দ্রাই সবচেয়ে বড় নয়, তার বড় বোনের স্বাস্থ্যের সমস্যা থাকায় সে প্রায়ই কাজ করতে পারে না। তার অন্য দুই দাদা আর দিদি অন্যত্র থাকে।
চন্দ্রা তার কর্মস্থলে
সাধারণত কাজে যাওয়া অথবা তার মায়ের ছোট খাটো কাজের জন্য কোথাও যাওয়া ছাড়া চন্দ্রা অন্য আর কোথাও যায় না। বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার অনুমতি তার নেই। মায়ের জন্য মুদিখানায় গেলে তার সঙ্গে তার বোনও যায়। চন্দ্রা অবশ্য নিজের বাড়িতেই খেলে। বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে চন্দ্রা খুব ভালবাসে, বিশেষত তার প্রিয় বন্ধু, যে তাকে খুব হাসায়।
তাদের ভবনের সিঁড়িতে চন্দ্রা
চন্দ্রের দিন
চন্দ্রার বাড়ি
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি খুব খুশি যে আপনি (CLARISSA গবেষক) এখানে এসেছেন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাড়িতে আমি নিরাপদ বোধ করি। আমার বাবা, মা আর বন্ধুরা আমার সঙ্গে আছে, আর কেউ না কেউ সবসময়েই আমার প্রতি নজর রাখছে। আমাদের বাড়িটা যদিও নিরাপদ, তবে আশে পাশের এলাকাটা তা নয়। এখানকার লোকেরা অন্যদের বিষয়ে নাক গলায়, আর যে কোনও বিষয়কে তারা একটা সমস্যা করে তুলবে। কয়েকদিন আগে আমার বন্ধু একটা ছেলের সঙ্গে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছিল, একজন দোকানদার তা লক্ষ্য করে আমাকে বলে। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করে না। একজনকে খুশি দেখলে অন্যরা তা পছন্দ করে না।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
আমি যখন পৌঁছলাম চন্দ্রার ছোট বোন তখনও ঘুমাচ্ছিল। চন্দ্রার বাবা চন্দ্রা আর তার বোনকে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলছিলেন। চন্দ্রাকে একটু লাজুক মনে হয়, সে আমার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলে না।
চন্দ্রা হেঁটে হেঁটে কাজে যাচ্ছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
কাজের জায়গায় পৌঁছাতে প্রায় ১০ মিনিট লাগে, কাজেই খুব দূরে নয়। তাছাড়া আমি তাড়াতাড়ি হাঁটি। বাড়িতে ফেরার সময় আমার পাঁচ মিনিট সময় বেশি লাগে, কারণ খারাপ ছেলেগুলিকে এড়ানোর জন্য সেই সময় আমি অন্য আরেকটি রাস্তা দিয়ে ফিরি।
আমি যখন ওভারটাইম কাজ করি, তখন আমি লম্বা রাস্তাটা দিয়েই ফিরি, কারণ সকালে আমি যে রাস্তা দিয়ে আসি, অন্ধকার হওয়ার পরে সেটাকে আর নিরাপদ মনে হয় না। কখনও কখনও আমরা দল বেঁধে ফিরি, কিন্তু যখন আমার বন্ধুরা ওভারটাইম কাজ করে অথচ আমি করি না,তখন আমি লম্বা রাস্তাটা দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। রাতে একা বাড়িতে ফিরতে আমার ভয় করে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
সকাল ৭.৪৫-এ চন্দ্রা কাজে রওয়ানা হয়। চন্দ্রা বলে যেহেতু সে ছোট তাই ছেলেরা তাকে উত্যক্ত করে না, কিন্তু সে অন্য মেয়েদের উত্যক্ত হতে দেখে। রাস্তার একটা মোড় সে এড়িয়ে চলে, কারণ সেখানকার ছেলেগুলি বিশেষভাবে খারাপ, তারা মেয়েদের ভয় দেখানোর জন্য তাদের পিছনে পিছনে আসতে থাকে।
শিশুর অভিজ্ঞতা
কারখানায় আমি সুতো কাটি, কাপড় কেটে পকেট বানাই আর ট্রাউজার ফিউজ করি। আমি কাঁচি দিয়ে ট্রাউজার আর পোশাকের বিভিন্ন অংশও কাটি, যা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কয়েকদিন আগে আমার আঙুল কেটে রক্ত পড়ছিল। আমি যা করি আপনি তা দেখলে বুঝতে পারবেন। আমি বেল্টের লুপ বানাই, পকেট সেলাই করি, জিপ জোড়া দিই, আর তাছাড়া আমাকে যা যা করতে বলা হয় আমি তা করি। প্রত্যেক দিনই আলাদা আলাদা কাজ থাকে। ভুল করলে আমাকে বকুনি দেওয়া হয়।
আমার সহকর্মীরা আমার প্রতি সদয়। আমি আমার কাজের জায়গাটা পছন্দ করি। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে পারি; সেখানে আমার কয়েকজন ভাল বন্ধু আছে।
গবেষকের অভিজ্ঞতা
চন্দ্রা বিগত চার মাস ধরে এই কারখানায় কাজ করছে। সে সুতো কাটে আর অন্যান্য ছোট ছোট কাজ করে। সে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে। এখন ঈদের সময় আসছে,তাই সে প্রতিদিনই কাজ করছে, এমনকি শুক্রবারও তার ছুটি নেই।
সবার ব্যবহারের বাথরুম
শিশুর অভিজ্ঞতা
এখন সকাল ৯.৩০ বাজে, আমি বাড়িতে ফিরে এসেছি। তারা (নিয়োগকর্তারা) আমাকে চলে যেতে বলেছেন। তারা বলেছেন প্রয়োজন হলে তারা আমাকে ডেকে নেবেন। আমি জানি তারা ডাকবেন না। তারা বলেছেন যে আমি কোন সাহসে CLARISSA গবেষককে কারখানায় নিয়ে গিয়েছিলাম।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
যেদিন তার সঙ্গে CLARISSA গবেষক ছিলেন, সেদিন চন্দ্রার সুপারভাইজার গবেষককে কারখানায় প্রবেশ করার অনুমতি দেননি,যদিও কয়েকদিন আগেই কথাবার্তা বলার পরে তারা রাজি হয়েছিলেন। কিছুক্ষণ আলোচনা করার চেষ্টা করার পরে আমি চন্দ্রাকে ছেড়ে চলে আসি, আমার পরিকল্পনা ছিল লাঞ্চের পরে তার সঙ্গে দেখা করার, কিন্তু পরে চন্দ্রার বাবা ফোনে আমাকে জানান যে চন্দ্রাকে বরখাস্ত করে হয়েছে, সে এখন বাড়িতে আছে।
চন্দ্রা বাড়িতে ছিল, তার পরিবার আর অনেক প্রতিবেশীও ছিলেন, আর চন্দ্রাকে দেখা মনে হচ্ছিল সে মানসিকভাবে আহত হয়েছে। প্রায় সেই সময়েই তার দিদি কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে এলো, কারণ তার শরীর খারাপ লাগছিল। চন্দ্রার মাতা চাপে পড়ে গিয়েছিলেন, তিনি কান্নাকাটি করছিলেন যে তাদের কেউই কাজ না করলে তাদের হাতে কোনও টাকা থাকবে না।
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি সকাল ১০.৩০-এ কাজে ফিরে গেলাম। আমি যখন ফিরে গেলাম, তখন কেউই কিছু বললেন না, এটা ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি। আবার কাজে ফিরতে পেরে ভাল লাগছে। এটা একটা স্বস্তি।
আমি ক্লান্ত বোধ করি না। আমি দাঁড়িয়ে অথবা বসে কাজ করতে পারি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
CLARISSA টিমের একজন সদস্য কল করে চন্দ্রার কারখানার মালিকের সঙ্গে আলোচনা করেন যাতে সে কাজে ফিরে যেতে পারে। চন্দ্রা আবার কারখানার দিকে রওয়ানা হল। সে বলেছিল আবার কাজ ফিরে পেয়ে সে খুশি হয়েছিল,তবে আমার মনে হয় সে আমার প্রতি রেগে গিয়েছিল।
মেয়েরা একটা মোবাইল ফোনে খেলছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি আমার ফোনে গেম খেলতে ভালবাসি। দুপুরবেলার খাওয়ার পরে আমি রোজই খেলি – এছাড়াও কাজে যাওয়ার আগে আর কাজ থেকে ফিরে রাতেও খেলি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
দুই বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে চন্দ্রা কাজ থেকে হেঁটে বাড়িতে ফেরে। কাজে ফিরে যেতে পেরে সে খুশি হয়েছে। তার খিদে পায়নি, দুপুরবেলা সে খুব কম খেয়েছে। একই বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে সে কাজে ফিরে যায়, কিন্তু তারা তাকে উপেক্ষা করে আগে আগে হাঁটছে দেখে সে মর্মাহত হয়। আমি বুঝতে পারছি যে আগে কারখানাতে যা ঘটেছে তার জন্যই তারা তার সঙ্গে কথা বলছে না। ফিরে আসার সময় সে আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
বিকেল ৫টা পর্যন্ত চন্দ্রা কাজ করছে। বাড়িতে ফেরার সময় সে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটছে, তাদের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য আমাকেও দ্রুত হাঁটতে হয়েছে। সে বলেছে, “আমি কাজে থাকতে পছন্দ করি, কারণ তাহলে আমি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারি।” সে আমাকে বলেছে যে তার বস আগে ভুল বুঝেছিলেন, তিনি মনে করেছিলেন যে আমি তার এবং কারখানার বিরুদ্ধে রিপোর্ট লিখব। আগের চেয়ে সে এখন আমার সঙ্গে সহজ হতে পেরেছে বলে মনে হয়।
বাড়িতে ফেরার সময় তার বন্ধু এসে তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। যখন তারা কাজ করছিল তখন সে চন্দ্রার হাত ধরে ছিল, আজকের ঘটনার পরে তারা আবার বন্ধু থাকতে পেরেছে বলে মনে হয়। চন্দ্রাকে এখন এতো খুশি দেখাচ্ছে।
চন্দ্রা আর এক বন্ধু একটা ফোনে খেলছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি বাড়িতে ফিরে এসে সবসময়েই দেখতে পাই যে আমার বন্ধুরা ইতিমধ্যেই সেখানে এসে গিয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে ফিরে এসে তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার ভাল লাগে।
আমি ফোনে গেম খেলি, লুডো খেলি, আড্ডা দিই, টিকটক দেখি, মজা করি আর বন্ধুদের সঙ্গে খেলি। আমি বাইরে গিয়ে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি একটা বন্ধ দোকানের সামনে খেলি অথবা আমাদের বাড়ির ভিতরে খেলি। আমার প্রিয় বন্ধু আমাকে হাসায় আর আমি তার সঙ্গে সবকিছু ভাগাভাগি করে নিতে ভালবাসি। সে যতক্ষণ এখানে থাকবে ততক্ষণ আপনি আমাকে হাসি-খুশি দেখবেন।
আমরা শুক্রবার খেলতাম, কিন্তু যেহেতু আমি কোনও ছুটি পাই না আর সবসময়েই কাজ করি, তাই খেলার জন্য সময় পাওয়া মুশকিল।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
সন্ধ্যা ১৭.৩০ থেকে চন্দ্রা তার ফোনে দুই ঘণ্টা আমার আর তার বন্ধুদের সঙ্গে গেম খেলে কাটায়। তারা হাসছে আর একে অপরের ছবি তুলছে আর টিকটক ভিডিও বানাচ্ছে। একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ রয়েছে, কয়েকজন প্রতিবেশীর জন্য তার বাবা-মা নাস্তা বানাচ্ছেন।