শিশুদের দিন সম্পর্কে গল্প

ঝিলিক, ১৬ বছর বয়সী মেয়ে

শিশুদের আসল নাম সুরক্ষিত
১৬ বছর বয়সী ঝিলিক পাঁচ বছর আগে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, কারণ তার পরিবারের ঋণ পরিশোধ করার জন্য তার বাবা-মা চাইছিলেন যে সে কাজ করে উপার্জন করুক। ঝিলিক সারাদিন তার বাবা, মা আর বোনদের সঙ্গে কাজ করে। তারা একটা নদীর ধারে একটা খোলা মাঠে মাটিতে চামড়া ফেলে পিটিয়ে শুকায়। তাদের দেহের পানির পরিমাণ কমে গিয়ে ডিহাইড্রেশন হওয়ার সমস্যা সব সময়েই থাকে, এছাড়া সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করা অথবা মজা করার মতো সময় ঝিলিক আর তার বোনদের থাকেই না। ঈদ উল ফিতরের পরে ঝিলিক একটা জুতোর কারখানায় কাজ শুরু করার অপেক্ষায় রয়েছে। সে মনে করে যে কারখানায় কাজ করলে সে নিরাপদে থাকবে।

ঝিলিকের জীবন সম্পর্কে

ঝিলিক তার বাবা, মা আর ছোট দুই বোনের সঙ্গে বালুরমাঠে থাকে। একটা দ্বিতল ভবনের দোতলায় একটা কামরায় তারা থাকে। ভবনের অন্য সবাইয়ের সঙ্গে তারা একই গোসলখানা আর খোলা রান্নার জায়গা ব্যবহার করে। তার বাবা-মা এই বাড়িটা বেছে নিয়েছিলেন কারণ ভবনটির দোতলায় গ্যাসের আলাদা সংযোগ ছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের ফলে অন্য কয়েকজন ভাড়াটিয়া গ্যাসের লাইনটা কেটে দিয়েছিলেন, তাই তারা এখন দোতলার রান্নাঘরটা ব্যবহার করতে পারে না,কারণ একটা গ্যাস সিলিন্ডারের দাম তাদের সামর্থ্যের মধ্যে নয়। পরিবারটিকে একতলায় নেমে খোলা জায়গায় জৈব চুলায় রান্না করতে হয়। বিগত দুই বছর ধরে পরিবারটি এই ভবনে বসবাস করছে। যখন গ্যাস লাইনের সংযোগ ছিল তখন ভাড়া ছিল মাসে BDT ২৫০০ (US $২৩), এখন প্রতিমাসে BDT ২২০০ (US $২০) ভাড়া দিতে হচ্ছে।

১৬ই মার্চ তারিখে একজন CLARISSA গবেষক সারা দিন ঝিলিকের সঙ্গে ছিলেন। তার দিনের অধিকাংশ সময়টাই যায় রোদে চামড়া শুকাতে, আর সে বলে যে তার প্রায় প্রতিটি দিনই এই রকমের।

Being leered at by boys in the street

“আমার মতো রোদে কাজ করলে আপনাকে বারে বারে পানি খেতে হবে, কিন্তু আমি যদি বেশি পানি খাই, আমাকে বারে বারে প্রস্রাব করতে হবে। তা করা সম্ভব নয় কারণ তাহলে প্রতিবারই আমাকে বাড়ির গোসলখানায় যেতে হবে।”

Pinning leather to the ground

পেরেক দিয়ে মাটিতে চামড়া আটকানো হচ্ছে

ঝিলিক প্রায় কোথাওই যায় না কারণ সে সবসময়েই কাজ করে। তার দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় হল বাজারে যাওয়া, কিন্তু তার জন্য তার কাছে সবসময় টাকা থাকে না।

নিজের পাড়ায় ঝিলিক ভয়ে ভয়ে থাকে, সে বলে যে পাড়াটা বিপজ্জনক। এখানে নেশাখোররা ঘুরে বেড়ায়, তারা অল্পবয়সী মেয়েদের উত্যক্ত করে। তাদের বাড়ির খুব কাছের জায়গাটা রাত্রিবেলায় খুব অন্ধকার থাকে, রাস্তায় কোনও আলো থাকে না। ঝিলিক একা কখনও রাস্তায় যায় না। বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে তার ছোট বোন সবসময়েই তার সঙ্গে থাকে।

“যখন রোদ ওঠে তখন অসহ্য লাগে, অন্য লোকজন বিশ্রাম নিতে যায় কিন্তু আমাকে কাজে যেতেই হয়।”

Leather pinned out to dry on open ground

খোলা জমিতে শুকানোর জন্য চামড়া পেরেক দিয়ে আটকানো হয়েছে

Jhilik pinning leather to the ground to dry

তার কর্মক্ষেত্রে ঝিলিক

ঝিলিকের কাজের জায়গাটা হল নদীর ধারে একটা খোলা স্থান। মাটির উপরে কাঠের বোর্ড রেখে তার উপরে কাঁচা আর ভেজা চামড়ার টুকরো পেরেক দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। সারা দিনে ঝিলিক ৪০০-৫০০ পিস চামড়া শুকায়, ফলে তার পিঠে ব্যথা হতে থাকে। কাজের জন্য পরিবারটির চড়া রোদের প্রয়োজন, যার ফলে কাজের সময় গরম লাগে আর ডিহাইড্রেশন হয়। একজন সুপারভাইজার সবসময়েই উপস্থিত থাকেন, কাছের একটা ছাউনিতে বসে তিনি পরিবারটির কাজের প্রতি নজর রাখেন।

মাঠ থেকে ঝিলিকদের বাড়ি হাঁটাপথের মধ্যে।

৫-৬ মিনিট হাঁটলেই ঝিলিক আর তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ি থেকে কাজের জায়গায় পৌঁছাতে পারে। গোসলখানায় যাওয়া, সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাওয়ার জন্য সে বাড়িতে যায়।

ঈদ উল ফিতরের পরে ঝিলিক একটা জুতোর কারখানায় কাজ শুরু করার অপেক্ষায় রয়েছে। সে মনে করে যে কারখানায় কাজ করলে সে নিরাপদে থাকবে।

Jhilik walking near her home

ঝিলিক তার বাড়ির কাছে হাঁটছে

ঝিলিকের দিন

০৬.৩০
বাড়িতে

শিশুর অভিজ্ঞতা

আমি সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ি, সকালের নাস্তা না করেই আমি সোজা কাজে চলে যাই। কাজের জায়গাটা আমাদের বাড়ির কাছেই, কিন্তু এখন আমার ঝিমুনি আসছে, আরও একটু ঘুমাতে চাইছি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

ধোয়ার কাজের জন্য একতলায় একটা পানির পাম্প আছে, কিন্তু প্রায় সবসময়েই পানির লাইন জ্যাম হয়ে থাকে অথবা একদম বন্ধ থাকে। সেই সময়ে পরিবারটির খুব অসুবিধা হয়।

A shed in a leather drying field

চামড়া শুকানোর মাঠে একটা ছাউনি

০৮.৩০- ১৬.৩০
খোলা জায়গায় চামড়া শুকানোর কাজে

শিশুর অভিজ্ঞতা

এই কাজের জন্য শক্তির প্রয়োজন। আমাকে পেরেকগুলিকে ঠুকে ঠুকে বোর্ডে ঢোকাতে হয় যাতে চামড়া সঠিকভাবে শুকায়।
প্রতিটি ব্যাচ পিন করা হয়ে গেলে আমি একটা বিরতি পাই। আমি ছায়ায় গিয়ে বসি।

আমি ১০ মিনিটের একটা গোসলখানার বিরতি নেওয়ার জন্য বাড়িতে যাই। আমি খুব বেশি বিরতি নিই না, তবে যখনই গোসলখানায় যাওয়ার দরকার হয় আমি বাড়িতে যাই। এখানে শ্রমিকদের যে গোসলখানা আছে আমি সেটা ব্যবহার করতে চাই না। এটা একেবারেই পরিষ্কার নয়।

আজকের প্রথম ব্যাচের চামড়াগুলো যখন শুকাতে থাকবে সেই সময়ে আমি বাড়িতে গিয়ে সকালের নাস্তা করব। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে সকালের নাস্তা করি। আজ আমার ভাগ্য ভাল যে তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা করছি। আজ যদি কড়া রোদ থাকতো, তাহলে বিরতি নেওয়ার আগে আমাকে আরও বেশি সময় কাজ করতে হত।

সকালের নাস্তার পরে আমার শক্তি বেশি আছে। তবে আরও একটু বেশি বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত – কিন্তু তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। একটা ব্যাচের চামড়া শুকিয়ে গেলে আমাকে সেইগুলি তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে আরেকটা ব্যাচ শুকাতে দিতে হবে।

সুপারভাইজার প্রতিদিন আমাদের বিভিন্ন ধরণের নাস্তা দেন। হয়তো সিঙ্গারা আর চা। আমি আধ ঘণ্টার বিরতি নিয়ে সবাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলি। এটা আমাদের জন্য মজার সময়।

আজ রোদ নেই। মাথার উপরে গনগনে সূর্য না থাকায় কাজ করতে খারাপ লাগছে না। বেলা ১২টা নাগাদ আমি একটু নাস্তা করি, তারপরে বেলা ৩টা নাগাদ বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খাই। এখন আমি আবার কাজ করছি।

আজ আমার একটু আরাম বোধ হচ্ছে। আজ খুব বেশি রোদ নেই, তাই সূর্য ডোবার আগেই আমি তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে পারি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

ঝিলিক তার পরিবারের সঙ্গে কাজ করে। সারা দিনে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার সময় কথা বলার মতো তার কোনও সহকর্মী নেই।

ভেজা চামড়ার টুকরোগুলিতে ঝিলিক হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছে আর একই সঙ্গে চামড়া টান টান করে দিচ্ছে। পরে সে পেরেকগুলি খুলে নিয়ে শুকনো চামড়াগুলি স্তূপ করে গুছিয়ে রাখে। সারা দিন নিচু হয়ে কাজ করতে করতে তার পিঠে ব্যথা হয়।

অন্য মানুষরা যখন দিনের বেলার তীব্র গরমে আড়ালে চলে যায়, তখনও ঝিলিক আর তার পরিবারকে কাজ করে যেতে হয়- রোদ যত কড়া হবে তারা তত বেশি চামরা শুকাতে পারবে। কাজটা অত্যন্ত ক্লান্তিকর, আর ডিহাইড্রেশনের সমস্যা সব সময়েই থাকে।

চামড়া শুকানোর মাঠের পাশে ঝিলিকের বোন সারাদিন ছাউনির নিচে বসে থাকে (অথবা যতক্ষণ তার বাবা, মা আর বোন চামড়া শুকানোর কাজ করে)। তার বাবা-মা তাকে একা বাড়িতে রেখে আসতে চান না, তাই সে সারাদিন ছায়ায় শুধুই বসে থাকে। কিন্ডারগার্টেনে না গিয়ে অথবা পাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে না খেলে এই ছয় বছর বয়সী শিশুটি একটা ভাঙাচোরা ছাউনির নিচে গরম বালির উপরে বসে থাকে, তার কাছে তার দিদির স্মার্টফোন ছাড়া বিনোদনের অন্য কোনও বিকল্প নেই।

A busy market

একটা ব্যস্ত বাজার

১৮.০০
বাজারে যাওয়া

শিশুর অভিজ্ঞতা

প্রত্যেক সপ্তাহে বাজারে যাওয়ার মতো টাকা আমার কাছে থাকে না, তবে যেদিন যাই সেদিন সত্যিই ভাল লাগে। ভিড় নিয়ে আমার কোনও সমস্যা হয় না যতোটা হয় অন্ধকার হওয়ার পরে পাড়ার রাস্তায় যেতে।

আমার একটু খারাপ লাগছে কারণ নিজের ইচ্ছা মতো কেনাকাটা করার জন্য আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে আছি। আমার ভাল লাগছে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গিয়েছে, তাই আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে।

যখনই সুযোগ পাই তখনই এই বাজারে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজ এখানে ভিড় আগে…খুবই ব্যস্ততা আছে আর এখানে প্রচুর মশা আছে। কিন্তু আমি সত্যিই এখানে আসতে চাই।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঝিলিক বাজারে যাচ্ছে, যাওয়ার পথে কয়েকজন বন্ধুকেও নিয়ে যাবে। চারটি মেয়ে একসঙ্গে হেঁটে বাজারে যাচ্ছে। তাদের খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে, যেতে যেতে তারা খুব কথা বলছে।
বাজারটায় খুবই ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে, অনেক লোকজন আছে আর বিভিন্ন দোকানে পোশাক, বাসনপত্র, জুতো থেকে স্ট্রিট ফুড সবই বিক্রি হচ্ছে। ঝিলিক তার বোনের সঙ্গে ঘুরছে কিন্তু কিছুই কিনছে না। সে তার বন্ধুদের কয়েকটা পোশাক বেছে নিতে সহায়তা করছে।

এইটাই হল একমাত্র সময় যখন ঝিলিককে আমি হাসতে দেখছি আর সে ভাল সময় কাটাচ্ছে। যখন সে কাজ করে তখন সেখানে কথা বলার মতো তার সমবয়সী কোনও মেয়ে থাকে না। ঝিলিকের শৈশবে আনন্দ খুবই কম। শিক্ষার সুযোগ অথবা বয়স উপযোগী বিনোদনের সুযোগ তার জীবনে নেই।

নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করলে তার বাড়ির কাছাকাছি এলাকাটাই ঝিলিকের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা। যখনই সে বাড়ি থেকে বাইরে যায়, অথবা যে মাঠে সে কাজ করে সেখানে যায় তখনই নিরাপত্তাহীনতার কারণে সে ভয় পায়। তার বাড়ির খুব কাছের এই ব্যস্ত বাজারটাতেও অন্ধকার নামলে মাদক সেবনকারীরা এসে জড়ো হয়।

২০.০০
সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে

শিশুর অভিজ্ঞতা

কখনও কখনও আমি টিকটক ভিডিও বানাই। তবে নিয়মিতভাবে বানানোর মতো সময় আমার থাকে না। বন্ধুরা কাছাকাছি বাস করলেও আমি তাদের সঙ্গে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে চ্যাট করি। বোনের সঙ্গেও মজা করতে ভাল লাগে, তবে কাজ থেকে ফেরার পরে ক্লান্ত লাগে। তাই অধিকাংশ সময়ে আমি ঘুমাই অথবা ফেসবুক পোস্ট দেখি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

সন্ধ্যাবেলায় ঝিলিক ফেসবুকে গিয়ে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে তার বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করে আর টিকটক ভিডিও দেখে। এখন (সন্ধ্যা ৬.৩০-এর পরে) ঝিলিকের বাড়ির বাইরে আর ভিতরে, উভয় জায়গাই অন্ধকার।
ভবনটায় আলো খুবই কম আর রাত্রিবেলায় পরিবারটির ঘরও প্রায় অন্ধকার। গোসলখানায় কোনও আলোই নেই। রাতে খাওয়ার পরে যদি তাদের গোসলখানায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়,তাহলে তাদের নিচে নেমে একতলায় যেতে হবে।

ঝিলিক ক্লান্ত হয়ে আছে, পরিবারটির রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে সাধারণত সে রাত ৯টার একটু পরেই শুয়ে পড়ে। তবে কখনও কখনও যখন সবাইয়ের সঙ্গে ভাগ করা খোলা রান্নাঘরটা ব্যস্ত থাকে, তখন ঝিলিকের শুতে যেতে দেরি হয়, কারণ তার পরিবারের রান্না করতে আর খেতে দেরি হয়।

ঝিলিক এর যাত্রা অন্বেষণ