শিশুদের মুখে শোনা তাদের গল্প জীবনের এক দিন

ফাহিমা, ১৬ বছর বয়সী মেয়ে

শিশুদের আসল নাম সুরক্ষিত
১৬ বছর বয়সী ফাহিমা একটা চামড়ার কারখানায় প্রায়ই সকাল ৮ থেকে রাত ১০ পর্যন্ত কাজ করে। কাজের চাপ যখন বেশি থাকে তখন সে সারা রাতই কাজ করে। কারখানাতে কাজ করা ছাড়া, যেটা তার বাড়ি থেকে কয়েক মিনিট দূরে, ফাহিমা খুব কমই অন্য কোথাও যায় – তার সারা সময়টাই কারখানার কাজে অথবা বাড়ির কাজে চলে যায়।

ফাহিমার জীবনের কথা

ফাহিমা তার বাবা, মা, বড় ভাই, বোন আর ভাতিজির সঙ্গে ঢাকায় একটা এক কামরার বাড়িতে থাকে। তাদের ঘরটা তাদের বাড়ির একতলায়, তাই জানালা দিয়ে রাস্তার গাড়ি আর রিক্সার আওয়াজ ভিতরে আসে। তার মা গৃহবধূ আর তার বাবা রিক্সা চালান। তার বড় ভাই একটা পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করে আর তার বোন কাজ করে একটা ব্যাগ তৈরির কারখানায়।

“আমার বাবা আমাকে খুব বেশি বাইরে যেতে দেন না। জুতোর কারখানাটা যেহেতু আমাদের বাড়ির কাছে, তাই তিনি আমাকে কাজে যেতে দেন।”

পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে কোভিড-১৯ অতিমারীর লকডাউনের (২০২০) পর থেকে ফাহিমা চামড়ার জুতো তৈরির একটা কারখানায় হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করেছিল।

পড়াশোনা করতে ফাহিমা খুবই আগ্রহী। সে ক্লাস নাইন পর্যন্ত (প্রায় ১৪ বছর বয়সে) একটা স্কুলে পড়েছে, কিন্তু অর্থের অভাবের কারণে পরিবারের সহায়তার জন্য সে আর তার বোন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।

“আমি স্কুল ছাড়তে চাইনি, কিন্তু আমাদের পরিবারের অবস্থার কারণে আর পড়াশোনা করতে পারিনি”

ফাহিমার কারখানা

একজন চেনাজানা মানুষ, যিনি জুতোর কারখানায় ইতিমধ্যেই কাজ করছেন, তার মাধ্যমে ফাহিমা তার কাজটা পেয়েছিল। তারপর থেকে ফাহিমা সেখানেই কাজ করছে, আর তার মাসিক আয় হল ৮,০০০ BDT (US$৭৪)

কারখানাটা বাড়ির কাছে হওয়ায় ফাহিমা রোজ হেঁটেই সেখানে যায়। কারখানাটা যদি কোনও অর্ডার না পায়, তাহলে ফাহিমারও কোনও কাজ থাকে না, তবুও তাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়। ব্যস্ততার সময় সে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে, মাঝে শুধু ১৫ মিনিটের একটা বিরতি থাকে। কাজের চাপ যখন বেশি থাকে তখন সে সারা রাতই কাজ করে।

ফাহিমা তার দিনের কাজগুলো নথিবদ্ধ করেছিল, যার মধ্যে ছিল তার দিন, কারখানায় যাওয়া, কাজ এবং তার সঙ্গে বাড়িতে আরবি শেখানো, রান্না করা আর সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির কাজ । সে অবসরের জন্য কিছুই করে না।

এটাই হল ফাহিমার মোটামুটি সারাদিন। ওষুধ আনার জন্য ফার্মেসিতে আর মাসে একবার বাজারে যাওয়া ছাড়া সে অন্য আর কোথাও খুব বেশি যায় না। কখনও কখনও একটা বাচ্চাকে আরবি শেখাতে ফাহিমা তাদের এলাকাতে অন্য বাড়িতে যায়। তবে সাধারণত তার বাবা তাকে খুব বেশি বাইরে যেতে দেন না। যখন জুতোর চাহিদা খুব বেড়ে যায়, তখন অবশ্য ফাহিমাকে কারখানায় রাত ৯টা অথবা ১০টা পর্যন্ত ওভারটাইম কাজ করতে হয়।
ফাহিমা তার সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটানো পছন্দ করে তবে সে তার স্কুলের বন্ধুদের অভাবও বোধ করে।

“আমি শুধু ভাবি ‘যদি’ আমি লেখাপড়া করা চালিয়ে যেতে পারতাম…”

ফাহিমার দিন

ফাহিমার কারখানা

০৯.০০ – ১৭.০০
কাজের সময়

শিশুর অভিজ্ঞতা

আমি সকাল ৮টা থেকে কারখানায় কাজ করি। আমি জুতার জন্য চামড়া পেস্ট করি অথবা কখনও কখনও চামড়া কাটি।

যখন জুতার চাহিদা বেশি থাকে, তখন আমাদের ওভারটাইম কাজ করতে হয়। কয়েক দিন আগে আমাদের রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছিল। আমাদের নাস্তা দেওয়া হয়েছিল আর ১৫ মিনিটের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। কখনও কখনও, রমজানের মাসে, আমাদের সারা রাত কাজ করতে হয়।

কাজের চাপ যখন খুব বেশি না থাকে, যেমন আজকে কিছুটা সময় চাপ কম ছিল, তখন আমি একটু ঘুমিয়ে নিই, গান শুনি আর সেলাই শিখি।

দুপুরের খাবার খেতে আমি বাড়ি যাই, তখন খেতেও ভাল লাগে। খাওয়ার পরে আবার কাজে আসতে আমার আর ভাল লাগে না।

কাজের পরিবেশ নিয়ে আমি খুশি। আমি আমার সহকর্মীদেরও পছন্দ করি, তবে স্কুলের বন্ধুদের অভাব আমি অবশ্যই অনুভব করি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

ফাহিমা সেলাই মেশিন ব্যবহার করা শিখছে যাতে ভবিষ্যতে সে একজন অপারেটর হিসাবে কাজ করতে পারে।

জুতোর কারখানায় ১৭ জন কর্মী আছে, তাদের মধ্যে ১২ জন মেয়ে আর ৫ জন ছেলে। কারখানার পরিবেশ সুন্দর আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

ছেলেদের আর মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা বাথরুম আছে। ছেলেরা আর মেয়েরা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করে। কাজের চাপ যখন বেশি থাকে তখন তাদের নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না, তবে আজ যেহেতু কারখানায় অর্ডার কম এসেছে, তাই কাজ খুব বেশি ছিল না। কাজ না থাকলেও তাদেরকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানাতে থাকতে হয়।

সব কর্মীরাই বন্ধু ভাবাপন্ন নয়। কেউ কেউ গান শোনে আর অন্যরা গল্প-গুজব করে। দুপুরে ফাহিমা বাড়িতে খেতে যায়, তখন তার সঙ্গে ভাই-বোনরাও খেতে বসে।

১৭.০০
বাড়িতে যাওয়া

শিশুর অভিজ্ঞতা

আজ আমার সঙ্গে কয়েকজন মহিলা সহকর্মী ছিল। আমরা একসঙ্গে হেঁটে বাড়িতে ফিরেছি, কারণ তারা আমাদের প্রতিবেশী।

অন্ধকার হয়ে এলে একলা হেঁটে বাড়ি ফিরতে আমার ভাল লাগে না। আমি যে রাস্তা দিয়ে যাই সেখান দিয়ে নানা রকমের মানুষজন যাতায়াত করে। তারা আমাকে বিরক্ত করে, বাজে কথা বলে। আমরা তাদের এড়িয়ে চলি। তাড়াতাড়ি হেঁটে আমরা সোজা বাড়িতে চলে আসি।

যে লোকগুলি আমাদের বিরক্ত করে তার সব মাঝ বয়সী। সাধারণত তারা বিবাহিতও বটে! সকালবেলায় (যখন) রাস্তা তখনও খালি থাকে কিন্তু আমার কোনও অস্বস্তি হয় না, আর তখন খারাপ লোকগুলোও থাকে না, তবে দুপুরবেলায় খেতে যাওয়ার সময় আর সন্ধ্যাবেলা আমার অস্বস্তি বোধ হয়। লোকজনের চলাচল যত বাড়ে, আমার অস্বস্তিও ততই বাড়ে।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

ওভারটাইম কাজ করার পরে ফাহিমা যখন অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যায়, তখন প্রায়ই রাত নয়টা অথবা দশটা বেজে যায়। রাত্রিবেলায় দল বেঁধে বাড়ি ফিরলে কোনও সমস্যা হয় না বলে বিবেচনা করা হয়। তবে রাতে ফাহিমার একা একা বাড়িতে ফেরা নিরাপদ নয় কারণ সেই এলাকার অনেক রাস্তাই খুব অন্ধকার এবং সেগুলি বিপজ্জনক।

আরবি শেখানো

১৭.১৫
আরবি শেখানো

শিশুর অভিজ্ঞতা

আমার ১১ বছর বয়স থেকেই আমি আরবি আর বাংলা শেখাচ্ছি। এখন আমার দুইজন ছাত্র আছে: একটা বাচ্চা আর অন্যজন বয়স্কা মহিলা। আমি যখন ওভারটাইম করি তখন বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য খুব দেরি হয়ে যায়, তবে এখন কাজের চাপ কম থাকায় পড়াতে পারছি।

কাজের চাপ থাকায় আমি ইতিমধ্যেই একটা পড়ানোর কাজ ছেড়ে দিয়েছি। আমার ছাত্রের বাড়ি আমাদের বাড়ির খুব কাছে, কয়েক মিনিট হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যায়। কারখানায় কাজের চাপ বেশি থাকায় আমি এটা করতে পারছি না। বাড়ি ফিরে এসে খুব ক্লান্ত লাগে, তাই গত মাসে পড়ানোর কাজ ছেড়ে দিয়েছি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

কাজ শেষ হয়ে গেলে ফাহিমা বাড়ি ফিরে গিয়ে বাচ্চাদের পড়ায়। তার ওভারটাইম যখন প্রথম শুরু হয়েছিল, তখন ফাহিমা পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন কাজের অর্ডার যখন কম থাকে, তখন তার মা তাকে আবার পড়ানো শুরু করতে বলেছেন। এখন দুইজন তার বাড়িতে পড়তে আসে।

একটা গরম হাড়ি

১৯.০০- ২১.০০
বাড়িতে বাড়ির কাজকর্ম করা

শিশুর অভিজ্ঞতা

আজ আমার বোন অসুস্থ, তাই আমি রান্নায় সাহায্য করছি – আর খেলে ভাল লাগে।

আমি বাড়ির কাজকর্ম করতে পছন্দ করি। আমাকে তা করতে হয় কারণ আমার মা অসুস্থ। মাকে সাহায্য না করতে পারলে আমার খারাপ লাগে। আমার বোনও বাড়ির কাজে হাত লাগায়।

আমি যখন রাত ৯টা অথবা ১০টা পর্যন্ত কাজ করি, তখন বাড়িতে কাজ করি না। আমার মা সবকিছু করেন, আমি শুধু খাই আর ঘুমাই।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

পড়ানোর পরে ফাহিমা রান্নাঘরে গিয়ে তার মাকে রান্নায় সহায়তা করে। তাদের বাড়িতে তাদের পরিবারের ঘর থেকে রান্নাঘরটা অনেক দূরে,তাই ফাহিমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। রান্না করার পরে সে রান্নাঘর থেকে গরম হাড়িগুলি ঘরে নিয়ে আসে, যা আমার বিপজ্জনক বলে মনে হয় কারণ তার পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

ফাহিমার যাত্রা অন্বেষণ করুন