শিশুদের মুখে শোনা তাদের গল্প জীবনের এক দিন

বাংলাদেশ, সগীর, ১৪ বছর বয়সী কিশোর

শিশুদের আসল নাম সুরক্ষিত
১৪-বছর বয়সী কিশোর সগীর দিনে ১১ ঘণ্টা ধরে কাঁচা চামড়া কাঁধে বহন করার কাজ করে, এর সাথে চামড়া মাটিতে ছড়িয়ে শুকানোর কাজও করে থাকে। সারাদিন ধরে প্রচণ্ড রোদের মধ্যেই ভারী মালামাল নিয়ে তাকে কাজ করতে হয়, যার ফলে তার শরীর ন্যুব্জ হয়ে গেছে। । উচ্চ তাপমাত্রায় থাকার ফলে তাকে হিট স্ট্রেস সহ্য করতে হয়। সগীর সর্বদা তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করার তাড়না অনুভব করে আর অন্যদের সাথে মিশলে সে ‘খারাপ হয়ে যাবে’ এই ভেবে সে দিন শেষে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশাও করে না’।

সগীরের জীবন সম্পর্কে

সগীর তার মা, বাবা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে থাকে। তার কাজ হচ্ছে ঢাকায় একটি নদীর তীরবর্তী খোলা জায়গার মাটিতেচামড়া শুকানো। তপ্ত রোদে কাজের যে অনুভূতি সেটা তার কাছে ‘মানুষের সহ্য সীমার বাইরে’ বলে মনে হয়। সে যখন কাজ করে তখন এতটাই গরম যে পথের কুকুরগুলোও নদীতে ঝাপাঝাপি করতে থাকে সগীরের পরিবার কোভিডের সময় তাদের গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে চলে আসে। গ্রামে থাকাকালীন সগীর পড়াশুনা করতো কিন্তু মহামারী কারণে তার স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা আসার পর থেকে সগীর শুধু চামড়া শুকানোর কাজ করেছে। ওর বাবা-মাও একই কাজ করছে। তার ছয় বছর বয়সী ছোট ভাই কোন কাজ করে না।

মাথার উপরে দুপুরের তপ্ত সূর্য

লকডাউনের সময় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সগীর পড়াশুনা করা একেবারে বন্ধ করে দেয়। এখন তার আর পড়াশুনা করতে ভালো লাগে না

সগীর তার কর্মস্থলে

CLARISSA গবেষণা দলের জন্য সগীর তার প্রাত্যহিক জীবন থেকে একটি দিনের কথা তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে তার সকাল ৮টা থেকে সূর্যাস্ত অবধি (সন্ধ্যে ৭টা) চামড়া বয়ে নিয়ে গিয়ে সেগুলিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার কাজ করা। তাকে ভারী বোঝা বহন করতে হয় এবং সূর্যের অতিরিক্ত তাপের কারণে তাকে প্রায় দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়।

শুকানোর জন্য সগীর প্রতিটি চামড়াকে মাটিতে পিন দিয়ে আটকে দিল

“এতটাই গরম যে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপরই কুকুরগুলো নদীতে ঝাঁপ দেয়। একাজে জড়িত শিশুদের চামড়া এতোটাই কালো হয়ে গেছে যে দেখে মনে হয় যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

সগীর বটগাছের ছায়ায় কিছুটা বিশ্রামের সময় পেলেও সে বেশিক্ষণের জন্য বিশ্রাম গ্রহণ করে না, কারণ যে যত-বেশি চামড়া শুকাতে পারবে, তত-বেশি রোজগার করতে পারবে।

সগীর ছায়া পেতে পারে শুধুমাত্র বটগাছের নিচে, যার নিচে বসে সে অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো

“সূর্যের তাপ এতোটাই বেশি যে তা মানুষের সহ্য সীমার বাইরে।“

সগির দিন

০৭.০০
বাড়িতে

শিশুটির অভিজ্ঞতা

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি সতেজ অনুভব করতে পছন্দ করি। আমার খিদে পায় তাই আমি খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়ি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা
সগীরের পরিবার খুবই ছোট একটি বাড়িতে থাকে এবং পরিবারের সমস্ত জিনিস এবং আসবাবপত্র স্তুপীকৃতভাবে রাখা থাকে। বাইরের তাপমাত্রা খুব বেশি হওয়ার আর বাড়ির তিনদিকে জানালা বা দরজা না থাকার কারণে বাড়ির ভেতরটি প্রচণ্ড গরম।

চামড়াগুলিকে রোদে শুকানোর জন্য সগীর সেগুলি মাটিতে বিছিয়ে দিচ্ছে

০৮.০০
চামড়া শুকানোর কাজ করা

শিশুটির অভিজ্ঞতা

আমি চামড়া শুকানোর কাজ করি। আমি কাজ করতে ভালোবাসি কিন্তু মাঝেমাঝে আমার একঘেয়েও লাগে। এর ফলে দিনের কিছু সময় আমার কাজ করতে ভালোলাগে আর কিছু সময় আমার খারাপ লাগে। তপ্ত রোদ ভালো লাগে না। তাই দিন যত গড়ায়, তাপ যত বাড়ে, আমার তত খারাপ লাগে।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

যে জায়গায় সগীর কাজ করে সেটি একটি সুবিশাল খোলা মাঠ যেখানে চামড়া শুকানো হয়। ছায়া যুক্ত স্থান সেখানে খুবই কম। শ্রমিকরা যখন চামড়া শুকানোর জন্য পরিশ্রম করে, তখন দেখে মনে হয়, যেন গরুর চামড়া শুকাতে গিয়ে তারা নিজেদের চামড়াই পুড়িয়ে ফেলেছে। তাদের গায়ের রঙ এতটাই কালো হয়ে গেছে, যেন মনে হয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সগীর একসাথে অনেক পরিমাণ চামড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নিয়ে যায়। কোনও শিশুর জন্য এমনকি কোনও প্রাপ্তবয়স্কর জন্যও এই কাজ খুব কঠিন। অন্যান্য শিশুরাও (ছেলে এবং মেয়ে) সগীরের মতোই একই কাজ করছিল। আর এতটাই গরম ছিল যে কুকুরগুলো পর্যন্ত মাঠের পাশের নদীর পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছিল। বাচ্চাদের এই গরমে কাজ করতে দেখে আমার মনে হয়েছিল যে এই দৃশ্য অন্ধকার যুগের বর্বরদের চেয়েও খারাপ। কিন্তু এই উত্তাপ এখানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় কারণ তারা যত-বেশি চামড়া শুকাতে পারবে তত-বেশি তাদের রোজগার হবে। আর তাই, তারা সূর্যাস্ত অবধি কাজ করে। সগীর বারবার বলছিল যে সে এই কাজ করতে চায় না, এবং অন্য কোনও কাজ করতে পারলে তা তার জন্য ভালো হবে। আমারও দেখে মনে হয়েছিল এই কাজ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিদিন ধরে এই কাজ করলে তা তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হবে।

একটা বটগাছের নিচে মানুষজন বসে আছে

কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া

শিশুটির অভিজ্ঞতা

দুই ঘণ্টা রোদে কাজ করার পরে একটু চা খেলে বেশ ভাল লাগে। নদীর ধারে বড় একটা বটগাছের নিচে বসে নৌকোগুলি দেখতে বেশ লাগে। গাছের ছায়ায় বসে বসে নদীতে নৌকোগুলি দেখার পরে আবার রোদে গিয়ে কাজ করতে ভাল লাগে না। দিনের শেষে আমার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কাজের পরে বিশ্রাম নিলে বেশ আরাম বোধ হয়।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সগীর একটা বড় গাছের নিচে গিয়ে বসল। আমি তাকে আর একটু সময় বসতে বললাম, কিন্তু সে বলল যে সে যতটা সময় বিশ্রাম নেবে তার ক্ষতি ততটাই বেশি হবে, কারণ তাহলে সপ্তাহের শেষে সে কম টাকা পাবে। যদিও সে চাইছিল তবুও সে বিশ্রাম নিতে পারল না।

১৮.৪৫
বাড়ি ফেরা

শিশুটির অভিজ্ঞতা

আমি যে খোলা মাঠে কাজ করি সেখান থেকে বাড়ি ফিরতে আমাকে প্রায় দুই মিনিট হাঁটতে হয়। অধিকাংশ সময়েই আমি রাস্তা ধরে যাই, তবে যখন হাতে সময় থাকে তখন আমি নদীর ধার দিয়ে যাই। সন্ধ্যাবেলায় নদীর ধার কিছুটা অনিরাপদ থাকে, অন্ধকার হয়ে যায়, ছিনতাইকারীরা থাকে আর থাকে মাদক-সেবনকারীরা। আমার আরও মনে হয় পুলিশের সোর্সরাও নিরাপদ নয়।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

সারা দিন কাজ করার পরে তার দেহ শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। সগীর বাড়ি ফিরে গোসল করল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চায় কিনা, কিন্তু সে বলল তা করলে সে গোল্লায় যাবে। আমি যখন তার কাছ থেকে চলে আসছিলাম, সে উজ্জ্বল হেসে আমাকে “বিদায়” জানাল।

সাগিরের যাত্রা অন্বেষণ করুন