

সাকিব, ১৭ বছর বয়সী ছেলে

সাকিবের জীবন নিয়ে
সাকিব তার বাবা, মা আর ছোট বোনের সঙ্গে টিনের তৈরি একতলা বাড়িতে থাকে।বাড়িতে দুইটি ঘর আছে। তারা অন্যদের সঙ্গে একই গোসলখানা ব্যবহার করে, খাওয়ার পানির জন্য একটা কল আছে। তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আর ব্রডব্যান্ড সংযোগ আছে, কিন্তু তাদের পারিবারিক আয়ের প্রেক্ষিতে ব্রডব্যান্ড খুবই ব্যয়বহুল।
কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় সাকিব স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সেই সময়ে তার বাবা-মা উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় চলে আসেন আর তার বাবা রিক্সা চালানো শুরু করেন।
২০২৩ সালের ১৬ই মার্চ তারিখে সাকিব যখন বাড়ি থেকে কাজে যায় এবং সন্ধ্যাবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় তখন একজন CLARISSA গবেষক তার সঙ্গে ছিলেন।
সেদিন দীর্ঘ সময় ধরে সাকিব কাজ করেছিল, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, আর কাজের চাপও ছিল খুব বেশি।

সাকিব আর তার বন্ধুরা অর্থ উপার্জন করা নিয়ে অনেক আলোচনা করে আর

“আমি সকাল ৯টায় কাজ শুরু করেছি আর এখন সন্ধ্যা ৬টা বেজে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছি।’

একদল কিশোর আড্ডা দিচ্ছে
দিনের শেষে সাকিব যে স্বস্তি পায় তা স্পষ্ট, কাজের শেষে বেড়িয়ে আসাকে সে জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছে।
সাকিবের বন্ধুরা – কাজের জায়গায় আর বাইরে – তাদের কাছে গেলে সে খুব স্বস্তি পায়।

সাকিব তার কর্মস্থলে
সাকিব একটা কারখানায় সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে মাসে BDT ৮০০০ (US $৭৪) উপার্জন করে। প্রথমে সেখানে সে আংশিক সময়ে কাজ করা শুরু করেছিল, তবে সে স্কুলে যেতে চাইত না আর আরও বেশি উপার্জন করতে চাইত, তাই সে পূর্ণ সময়ের জন্য কাজ করা শুরু করল। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার জন্য এখন সাকিব আক্ষেপ করে। সে মনে করে এখন তার স্কুলে ফিরে যাওয়া মুশকিল, কারণ তাহলে এখন তাকে সমবয়সীদের পরিবর্তে ছোটদের সঙ্গে পড়তে হবে,কারণ তার অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
১৫০ জন লোক কারখানাটাতে কাজ করেন। সাকিব বলে সে যখন এই কারখানায় প্রথম এসেছিল তখনকার তুলনায় এখন কর্মীদের সংখ্যা কমে গিয়েছে। সাকিবের বক্তব্য অনুসারে এই কারখানায় কাজের জন্য শিশুদের নিয়োগ করা হয় না, তবে কোনও কোনও অপ্রাপ্তবয়স্করা, যারা কাজ পেতে অত্যন্ত আগ্রহী, তারা নিজেদের জন্মতারিখ জাল করে এখানে কাজ করে।
যেহেতু কারখানায় কর্মী সংখ্যা কম, তাই সাকিব এবং তার সহকর্মীদের নিজেদের উৎপাদনের হার বাড়িয়ে তা পুষিয়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে যখন কাজের চাপ কম থাকে তখন সে কাজের সামাজিক দিক উপভোগ করে।

সাকিবের কারখানার বাইরে
সাকিবের দিন

সাকিবের বাড়ি
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি সকাল ৮টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে পড়ি যাতে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারি। ৮.৩০ নাগাদ আমি বাড়ি থেকে রওয়ানা হই। কাজের জায়গায় পৌঁছাতে আমার ১৫ মিনিটেরও বেশি সময় লাগে।
এখন ঠিক আছে, তবে কখনও কখনও সকালে এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে কাজে যেতে বিরক্ত লাগে। তবে আমার কিছুই করার নেই, আমি নিজেই এটা বেছে নিয়েছি, কাজেই আমাকে কাজ করতেই হবে। আমাকে কারখানায় গিয়ে কাজ করতেই হবে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
সাকিব সকাল ৮টার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে কারণ তাকে ৯টার আগে কারখানায় পৌঁছাতে হবে। কাজে যাওয়ার আগে সে সকালে কিছু খায় না। বাড়ি থেকে হেঁটে কারখানায় যেতে তার ২০ মিনিট সময় লাগে।

শিশুর অভিজ্ঞতা
আজ কারখানায় যেতে আমার ভাল লাগছে, তবে কখনও কখনও যখন আমি সুপারভাইজারের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার কথা ভাবি, তখন সেখানে যেতে ইচ্ছে করে না। কখনও কখনও তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করেন, তবে সব সময় নয়, যখন তিনি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমাদের উপরে চাপ দিতে চান শুধু তখনই চিৎকার করেন। মাঝে মাঝে আমরাও চেঁচিয়ে উত্তর দিই। শ্রমিকদের গায়ে তিনি হাত তুলতে পারবেন না।
আমি একা একাই কারখানায় যাই। আমার যাওয়ার রাস্তাটা যদিও খুব ভালভাবে তৈরি নয় অথবা হাঁটার জন্য এটাই সেরা রাস্তা নয়, তবে আমি এটা দিয়ে যাই কারণ সবচেয়ে কম সময়ে এই রাস্তা দিয়েই যাওয়া যায়।

বাইরের কাউকে কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না।
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি সবসময়েই চেষ্টা করি সময় মতো কারখানায় পৌঁছাতে, দেরি করে পৌঁছাতে চাই না। এখন আমার ভাল বোধ হচ্ছে, কারণ এখানে আমার কয়েকজন বন্ধু কাজ করে। এখন কাজ করতে আমার খারাপ লাগছে না।
সকালবেলায় সবকিছুই ঠিকভাবে চলছে। আমি আমার কাজ উপভোগ করছি। আমার চারপাশে পরিচিত মানুষজন রয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার বন্ধু, আমরা সবাই একটি দল হিসাবে কাজ করি। এর ফলে আমি সহজে আর শান্তিতে কাজ করতে পারি।
লাঞ্চের আগে আমি চাপ বুঝতে পারি। সুপারভাইজার আমাদের উপরে খুব বেশি চাপ দিচ্ছেন।, যেহেতু একমাত্র আমিই চামড়ার টুকরো কাটি, তাই এখন আমার উপরে বেশ চাপ আছে। যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উৎপাদন করতে হয়, তখন কাজ শেষ করার জন্য আমাদের উপরে সুপারভাইজারের চাপ বেশি থাকে।
আমার বিভাগের তিনজন শ্রমিক আজ কাজে আসেননি। তাই আমরা যারা উপস্থিত আছি তাদের উপরে অনুপস্থিতদের কাজের ভার পরে। তাদের কাজ পুষিয়ে দিতে আমাদের অতিরিক্ত কঠিন কাজ আর অতিরিক্ত উৎপাদন করতে হবে। কাজেই আমার খারাপ লাগছে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
কারখানায় আসার পরে সাকিবকে খুশি বলে মনে হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে তার বন্ধুরা কাজ করে, তাদেরকে দেখে সে খুশি হয়েছে। আমি তার সঙ্গে কারখানায় ঢুকতে পারিনি, তবে আলোচনা করার পরে তার সুপারভাইজার রাজি হয়েছেন যে সাকিবের সারা দিনের কাজের মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় তার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারব।
সাকিবের কাজ হল চামড়া কাটা। তার নিজের কেটে যাওয়ার ভয় আছে।
সাকিবকে তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে।এই বিশেষ দিনটিতে তার উপরে কাজের চাপ খুব বেশি আছে কারণ বড় একটা অর্ডারের কাজ চলছে, আর শুধুমাত্র সাকিবই কাটার কাজ করে। দিনের মাঝামাঝি এসে তাকে ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে, সে বলছে যে তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য তার সুপারভাইজার তার প্রতি চিৎকার করেছে। অনেক কর্মী অনুপস্থিত থাকায় প্রত্যাশা করা হচ্ছে বাকি কর্মীরা তাদের নিজেদের উৎপাদনের হার বাড়িয়ে ঘাটতি পুষিয়ে দেবে।
আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য সে যখন একতলায় নেমে এলো, তখন নিরাপত্তা কর্মীরা আর অন্যান্য লোকজন আমাদের ঘিরে রেখেছিল। আমার মনে হয় না সে খোলাখুলি কথা বলতে পেরেছিল।

শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি যে অবশেষ খাবার খেতে বাড়িতে যেতে পারছি তার জন্য শান্তি পাচ্ছি। এই সময়েই আমি খাই। খাওয়ার পরে সামান্য বিশ্রামও নেওয়া হয়েছে – যদিও বিশ্রাম নেওয়ার মতো সময় আমার থাকে না, কারণ কারখানা থেকে বাড়িতে আসা যাওয়া করতে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় লাগে, তাই বাড়িতে ৩০ মিনিটেরও কম সময় থাকতে পারি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
বেলা ১টায় সাকিব খাবার খেতে বাড়িতে যায়। তার হাতে মাত্র এক ঘণ্টা সময় থাকায় সে দ্রুত হাঁটে।
সাকিবের কাছে দুপুরের খাওয়ার সময়টা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সকাল থেকে কাজ করার পরে সে তখন বিশ্রামের সুযোগ পায়, তবে খেতে আর বিশ্রাম নিতে তার হাতে আধ ঘণ্টারও কম সময় থাকে – বিরতির বাকি সময়টা চলে যায় কারখানা থেকে বাড়িতে হেঁটে আসা যাওয়া করতে।

চামড়া কাটার কাঁচি
শিশুর অভিজ্ঞতা
দুপুরের খাওয়ার পরে গায়ে অনেক বল পাচ্ছি বটে, তবে আমাদের কাজের ভার বেড়ে যাচ্ছে, সুপারভাইজার আবার আমাদের উপরে চাপ দিচ্ছেন।
দুপুরের শেষ দিকে আমার কাজের ভার কমে যাওয়ায় ভাল লাগছে। সুপারভাইজার আর আমাদের প্রতি চিৎকার করছেন না। তাড়াহুড়ো না করে আমি নিজের গতিতে কাজ করে যেতে পারি।
বেশ হালকা বোধ হচ্ছে কারণ আজ আমাকে ওভারটাইম কাজ করতে হবে না। আমার উদ্বেগ হচ্ছিল যে আমাকে করতে হতে পারে। সুপারভাইজার আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন যে আমাকে করতে হবে না। তাই বেশ ভাল লাগছে, আর আজ সন্ধ্যাবেলা আমি বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাব।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
খাওয়ার পরে সাকিবকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে। বিকেল ৬টার সময় সাকিব কারখানা থেকে বেড়িয়ে এলো। তার হালকা লাগছে যে দিনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে আর এই বিশেষ দিনটিতে ওভারটাইম কাজ করার জন্য শ্রমিকদের মধ্যে থেকে তাকে বেছে নেওয়া হয়নি।

সন্ধ্যাবেলায় নদীর ধারে
শিশুর অভিজ্ঞতা
কারখানা থেকে বেড়িয়ে এসে বেশ ভাল লাগছে। কাজ করার জন্য আমাদের উপরে যেভাবে চাপ দেওয়া হয় তাতে মনে হয় ঠিক যেন জেলখানায় আছি। কখনও কখনও সুপারভাইজারের সঙ্গে আমরা, শ্রমিকরা, তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। তবে তারা আমাদের গায়ে হাত তুলতে পারবেন না।
আমি খুব খুশি যে আমার দিনের কাজ অবশেষে শেষ হয়েছে, এখন আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারব।

রাত্রিবেলায় নদীর ধারে
শিশুর অভিজ্ঞতা
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে পেরে খুব ভাল লাগছে। আবহাওয়া খুবই ভাল, সারাদিন কারখানার মধ্যে থেকে এখন বাইরে এসে ভাল লাগছে। এখন নিজেকে মুক্ত আর হালকা মনে হচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে, কথাবার্তা বলতে আর মজা করতে খুব ভাল লাগে। তারাও কারখানায় কাজ করে, আর তারাও এই মাত্র কাজ থেকে ছুটি পেয়েছে।
তাদের সঙ্গে থাকতে দারুণ লাগে। আমি ভাগ্যবান যে তাদের পেয়েছি। যদিও আগামীকাল আমাকে কাজ করতে হবে, তবে এখন আমি তা নিয়ে ভাবছি না। আমি বর্তমান সময়টা উপভোগ করছি।
আড্ডা মারার জন্য এটাই একমাত্র জায়গা। যাওয়ার মতো অন্য আর কোনও জায়গা নেই। হাওয়া খাওয়ার জন্য সবাই এখানেই আসেন, তবে এখানকার হাওয়া ততটা তাজা নয়।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
কাজের পরে বন্ধুদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য সাকিব একটা খোলা জায়গায় যায় যেখানে নৌকা করে নদী পারাপার করা হয়। কাজের পরে তার সব বন্ধুরাই এখানে আসে। এটা একটা দুর্গন্ধময় বিপজ্জনক জায়গা, কিন্তু তাদের খেলার জন্য অন্য কোনও মাঠ নেই। একসময় মাঠ ছিল বটে, তবে সেখানে এখন বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে।