অশনির, ১৫ বছর বয়সী ছেলে
অশনির জীবনের কথা
সকালবেলা দুই ঘণ্টা স্কুলে পড়াশোনা করার পরে অশনির প্রিন্টিং ও প্যাকেজিংয়ের কাজ করে। অশনির তার ছোট ভাই, মা আর বাবার সঙ্গে ঢাকার গজমহলে বাস করে। তাদের বৃহত্তর পরিবারের যৌথ মালিকানাধীন একটি চারতলা ভবনের একতলায় তাদের পরিবারটি বাস করে। ভবনটির নির্মাণে নিজের অবদানের জন্য আশনিরের বাবা ব্যাঙ্ক থেকে ৪০০,০০০ BDT (US $৩৭০০) ঋণ নিয়েছিলেন, এই ভবনটি থেকে ভাড়া বাবদ আশনিরের পরিবারটি মাসে ৪০০০ BDT (US $৩৬) পায়।
আশনিরের বাবা ড্রাইভার হিসাবে কাজ করেন, তাকে খুব কমই বাড়িতে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে তিনি বাইরে থাকেন এবং কয়েকদিন পরে ফেরেন, তবে তার পরিবারের বাকিদের কাছে এটা স্পষ্ট নয় যে এই কয়দিন তিনি কী করেন। আশনিরের মা গৃহবধূ, আর আশনিরের ছোট ভাই একটা প্লেগ্রুপে যায়।.
চায়ের দোকান
কোভিড-১৯ অতিমারীর আগে অশনির স্কুলে যেত, কিন্তু স্কুলগুলি যখন বন্ধ হয়ে গেল আর তার বাবা কাজ হারালেন, তখন পরিবারটির আর্থিক সমস্যা শুরু হল, ফলে অশনিরও আর স্কুলে ফিরে যেতে পারল না।
অশনির তার ফোনে গেম খেলছে
কোভিড-১৯ অতিমারীর আগে অশনির স্কুলে যেত, কিন্তু স্কুলগুলি যখন বন্ধ হয়ে গেল আর তার বাবা কাজ হারালেন, তখন পরিবারটির আর্থিক সমস্যা শুরু হল, ফলে অশনিরও আর স্কুলে ফিরে যেতে পারল না।
এখন সে দিনে কয়েক ঘণ্টা স্কুলে গিয়ে ইংরেজি আর অংক সহ তিনটি ক্লাস করে, যার জন্য মাসে ৭০০ BDT (US $৬.৫০) খরচ হয়। কখনও কখনও অশনির নিজেই ফি দেয় আবার কখনও কখনও তার বাবা দেন।
২০২৩ সালের ১৩ই মার্চ তারিখে অশনির নিজের চলাফেরা রেকর্ড করেছিল যাতে তার দিন কেমন কাটে তা আমরা বুঝতে পারি। অশনির খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায়। স্কুলের পরে সে কাজে যায়। কাজের পরে সে ‘কোচিং’-এ যায় যাতে সে তার স্কুলের কাজ শেষ করতে পারে আর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে। অশনির বলেছিল যে সেই দিনটি তার অন্য সাধারণ দিনগুলির থেকে আলাদা রকমের ছিল, কারণ সেই দিন সে মোবাইলে তার প্রিয় গেম, ফ্রি ফায়ার খেলার জন্য সময় পেয়েছিল, যা সাধারণত অন্য দিনে স্কুলের পরে কাজে যাওয়ার জন্য করা যায় না। অনেকদিন চেষ্টা করার পরে সেই দিন সে চুল ছাঁটার জন্য সময় পেয়েছিল।
অশনির ফুটবল খেলতে ভালবাসে, তবে সে খুব কমই খেলতে যায়, কারণ স্কুলে আর কাজেই তার সব সময় চলে যায়। সপ্তাহের শেষে সে ঘুমাতে আর মোবাইল ফোনে গেম খেলতে ভালবাসে।
অশনির তার নিজের এলাকায় চলাফেরাকে নিরাপদ বলে বর্ণনা করেছে, কিন্তু একটা চায়ের দোকানকে সে ‘নিরাপদ নয়’ বলে চিহ্নিত করেছে, কারণ বয়স্ক মানুষরা সেখানে বসেন আর তারা অশনিরকে ধূমপান করতে দেখলে বিরক্ত হতে পারেন। সে নিজের এলাকার পরিচিত চায়ের দোকানগুলিতে ধূমপান করতে একটু সংকোচ বোধ করে।
অশনির একটা যন্ত্র চালাচ্ছে
অশনির বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধরণের কাজ করেছে। সে চাকরি শুরু করেছিল একটা জুতার কারখানায়, সেখানে তাকে ভারী বোঝা বইতে হত, ফলে বেশ কয়েকবার তার ঘাড়ে টান লেগেছিল। সে জুতায় রাসায়নিক লাগানোর কাজও করেছে, এতে সে অসুস্থ হয়ে পড়ত। প্রথম চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পরে, সে একটা চালের দোকানে কাজ নিয়েছিল, কিন্তু সেখানেও তাকে ভারী বোঝা বইতে হত আর ধুলোর জন্য নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হত। তারপরে অশনির প্রিন্টিং আর প্যাকেজিংয়ের কাজটা পায়, যা এখন সে করছে, এতে তার উপার্জনও আগের চাকরিগুলির তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। স্কুলে যাওয়ার জন্য আশনিরের ম্যানেজার তাকে ছুটি দেন। তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার ফি দিয়েছিলেন এবং সকালের নাস্তা করার জন্যও তিনি অশনিরকে কিছু অর্থ দেন।
যদিও অশনির তার বর্তমান চাকরিটাকে ‘ভাল’ বলে মনে করে, তবে এখানের কাজে একটা যন্ত্র ঘুড়িয়ে তার হাতে ফোস্কা পড়ে আর পিঠে ব্যথা হয়।
যদিও অশনির তার বর্তমান চাকরিটাকে ‘ভাল’ বলে মনে করে, তবে এখানের কাজে একটা যন্ত্র ঘুড়িয়ে তার হাতে ফোস্কা পড়ে আর পিঠে ব্যথা হয়।
হাতে ফোস্কা পড়েছে
অশনির দিন
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়তে পছন্দ করি। আমি সকাল ৬.০০ উঠে পড়ি আর তারপরে প্রস্তুত হয়ে এক ঘণ্টা পড়াশোনা করি। আজ আমার অংক পরীক্ষা আছে, তাই আমি একটু বেশি সময় ঘুমিয়েছি যাতে অংকগুলির সমাধান করতে পারি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
আশনিরের বাবা খুব সকালে বেড়িয়ে গিয়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি রাতে বাড়িতে ফেরেন না। অশনির তার বাবার অভাব খুব অনুভব করে, কিন্তু মায়ের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক আছে।
কর্মজীবী শিশুদের জন্য অতিরিক্ত টিউশন
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি ৮.৪০-এ স্কুলে যাই। আমি স্কুলে যেতে ভালবাসি কারণ সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় আর আড্ডা মারা যায়। আমরা খুব মজা করি। এছাড়াও পরীক্ষা দিতে আমার ভাল লাগে। আমি প্রতিযোগিতা পছন্দ করি। আমি পড়াশোনা করতে ভালবাসি, কিন্তু কাজের জন্য সবসময় পড়তে পারি না।
আজ আমার অংক পরীক্ষা ছিল। আমি অংকে ভাল, তবে পরীক্ষার সময় চাপ হয়।
বেলা ১১টা নাগাদ আমার ক্ষুধা পায় কারণ আমি সকালে নাস্তা করি না।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
অশনির পড়াশোনাও করে আবার কাজও করে। সে পূর্ণ সময়ের জন্য পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু তার পরিবারের আর্থিক সমস্যার জন্য সে চাকরি ছাড়তে পারে না।
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি হাজারীবাগের একটা পুরানো কারখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, যেখানে ছেলেরা জড়ো হয়ে মদ খায় আর গাঁজা টানে। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েদের হয়রানি করা হয়। আমি এখানে আসা পছন্দ করি না।
আমি অনেকদিন ধরে চুল কাটার কথা ভাবছি। কিন্তু স্কুলের পরীক্ষা আর অফিসের কাজের জন্য সময় পাইনি। এখন স্কুল আর কাজের মাঝে কিছুটা সময় পেয়েছি, তাই চুল কাটাতে এসেছি।
চুল কাটলে আমাকে দেখতে বেশ স্মার্ট লাগে। বাড়িতে ফিরে গোসল করে ফোনে গেম খেলার মতো সময়ও আমার আছে। আমি এটা করতে চাই, কিন্তু ছুটির দিনগুলি ছাড়া সাধারণত আমি সময় পাই না। তাই আমি খুব খুশি আছি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
এই এলাকার একটা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমার খুব ভয় করে। সেই রাস্তাটার দুই পাশেই উঁচু দেওয়াল আছে, রাস্তাটাও খুব সরু, তাই নিরাপদ মনে হয় না। ।
অশনির একটা প্রিন্টিং মেশিন চালাচ্ছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
প্রতিদিন একটা যন্ত্রে আমি হাজার হাজার লোগো ছাপি। তবে আজ আমি যতো কাজ করেছি আগে কখনই তা করিনি। আজ অন্য কোনও কর্মী কাজে আসেননি, তাই অন্য দিনের তুলনায় কাজটা কঠিন ছিল। অন্য দিনগুলিতে এতো কষ্ট হয় না।
আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, তবে চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাওয়ার পরে ভাল লাগছে। চা খেলে আমার চাপ কমে চায় আর ভাল লাগে।
দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রের পিছনে বসে কাজ করে বিকেল ৫টা নাগাদ আমার ঘাড় ব্যথা শুরু হল।
আজ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আমার ঘাড় নুয়ে পড়ছে, কোনও কাজই ভালভাবে করতে পারছি না। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হয়। কখনও কখনও এই রকম মনে হয়। একটানা কাজ করতে খারাপ লাগে।
কাজ ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা হয়।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
অশনির একা একা কাজ করছে। তার নিয়োগকর্তা তার পাশেই বসেন, তার কাজ দেখেন। মাঝে মাঝে তিনি ভুলগুলো ধরিয়ে দেন। আশনিরের বাবা বড় পরিমাণে ঋণ নিয়েছেন, বাবার বেতনের সবটাই ঋণ পরিশোধ করতে লেগে যায়। পরিবারের অন্যান্য সব খরচ আশনিরের উপার্জন থেকেই মেটানো হয়। তাই তার এই চাকরিটা পরিবারটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একটি কোচিং অথবা টিউশন সেন্টার
শিশুর অভিজ্ঞতা
কাজের পরে কে আরও পড়াশোনা করতে চাইবে? দিনের বেলায় পড়াশোনা করার জন্য আমার সময় থাকে না, তাই আমি যদি কোচিংয়ে না যাই তাহলে আমি পড়া বুঝতে পারব না আর আমার শিক্ষাও শেষ করতে পারব না। তাই কোচিং খুবই জরুরি।
তারপরে সারা দিন কাজ করে শরীরে আর শক্তি থাকে না, তাই আমার মেজাজ ভাল নয়। আগামীকাল আমার ইংরেজি পরীক্ষা। আমি খুব ক্লান্ত, তাই মনোযোগ দিতে পারছি না।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
দিনের অনেকটা সময় অশনির কাজ করে, তাই পড়াশোনা করার জন্য সময় পায় না। তাই পড়াশোনা করার জন্য সন্ধ্যাবেলায় সে অতিরিক্ত প্রাইভেট টিউশন নেয়। এটা তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই ক্লান্ত থাকলেও সন্ধ্যাবেলায় সে যায়।