কাকলি, ১৩ বছর বয়সী মেয়ে
কাকলি, ১৩ বছর বয়সী মেয়ে
কাকলি তার ছোট দুই ভাইকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঢাকার গজমহলে থাকে। তার মা একটি কারখানায় কাজ করে। কাকলির এক ভাই একটি চামড়ার কারখানায় কাজ করে আর এক ভাই মাদ্রাসায় (ইসলামিক স্কুল) পড়াশুনা করে। তার বড় ভাই এবং বোন দুজনই বিবাহিত এবং আলাদা থাকে। কাকলি ছোটবেলা থেকে দেখেছে, তার মা একাই নিজের উপার্জন দিয়ে সংসার চালায়। কাকলীর বাবা ওদের সাথে থাকে না এবং পরিবারে প্রতি কোনও দায়িত্ব পালন করে না।
১৩ মার্চ ২০২৩ তারিখে, কাকলির কর্মস্থল, রপ্তানি-কেন্দ্রিক ব্যাগ তৈরির কারখানা, যেটি তার বাড়ি থেকে প্রায় ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ, সেখানে যেতে যেতে সে নিজের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে এবং নথিভুক্ত করেছে।
ব্যাগ বোনা
“আমি প্রতিদিন একটা করে কাজ করি, এই কাজ আমাকে সম্পূর্ণ একাগ্রতার সঙ্গে করতে হয়। আমি না থেমে, একভাবে কাজ করতে থাকি। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আমি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে এই কাজে নিয়োজিত করি।”
কাকলি আরাম করছে এবং তার চুল শুকাচ্ছে
কাকলির গতানুগতিক দিনগুলি এরকমই। সে বাড়ি এবং কারখানা ছাড়া অন্য কোথাও যায় না।
কারখানায় থাকলে কাকলি নিরাপদ বোধ করে। কাজের সময় সে অন্যদের সাথে গল্প না করে নিজের কাজ শেষ করার দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়। সে বাড়ির কাজ বিশেষ করে না আর বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। CLARISSA গবেষণায় অংশগ্রহণ করার ফলে, কাকলির বন্ধুরা তার বাড়িতে আসে আর এটা তার কাছে খুব ভালো লাগে কারণ সাধারণত সে এরকম সুযোগ পায় না।
কাকলি তার কর্মস্থলে
কাকলী ও এই এলাকার অন্যান্য শিশু শ্রমিকরা কারখানায় কাজ করার জন্য তাদের জন্ম নিবন্ধন জাল করেছে। তারা নিজেদের ১৮ বছর বয়সী বলে দাবি করলেও আসলে তাদের বয়স অনেক কম, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১৫ বছরেরও কম। এমনকি, একটি মেয়ে জন্ম ্নিবন্ধনে তার নাম পাল্টে ফেলেছে এবং কারখানার সবাই তাকে তার ছদ্মনামেই চেনে।
একটি জন্ম নিবন্ধনের কাগজ
কাকলির কর্মস্থলে যাওয়ার রাস্তা
“আমি প্রত্যেকদিন কাজ করতে যাই আর বাড়ি ফিরে আসি। এটাই আমার রোজকার একমাত্র রুটিন।”
কারখানায় কাজে যাওয়ার সময় কিছু ছেলে তার মুখ ঢাকার কাপড় টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। কারখানা থেকে ফেরার পথে কাকলি অনিরাপদ বোধ করে, সে মনে করে মেয়েদের জন্য রাস্তাটা মোটেও নিরাপদ নয়। ঠিক কেন তার এমন মনে হচ্ছে সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত নয়, কিন্তু সে বিশ্বাস করে এই এলাকার লোকেরা ভাল নয়। তাছাড়াও সে এই জায়গা সম্পর্কে যে গুজব আছে সেই বিষয়ে সচেতন এবং অনুমান করে এখানে অবশ্যই কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে। সে লক্ষ্য করেছে নেশা করে এমন কিছু ছেলে প্রায়ই এই এলাকায় জড়ো হয়। আশেপাশে কাউকে না দেখলে কাকলি নিরাপদ বোধ করে।
এটা আমার কাজ, আমায় আজকেই শেষ করতে হবে.. মাঝে মাঝে একঘেয়ে লাগলেও কাজ বন্ধ করি না। “
কাকলির দিন
শিশুর অভিজ্ঞতা
প্রতিদিন আমাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। আমি ৭ টায় ঘুম থকে উঠলে, আমার ঘুমের ঘোর কাটে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি সত্যিই ঘুম থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। কিন্তু যাই হোক না কেন, আমাকে ঘুম থেকে উঠে কাজে যেতেই হবে। আমার আর কোন রাস্তা নেই।
গবেষকের অভিজ্ঞতা
কাকলি একটি সংকীর্ণ ছোট ঘরে থাকে এবং তার পরিবারের চারজনের সঙ্গে ছারপোকা ভরা এক বিছানায় ঘুমায়। যার ফলে শান্তিতে ঘুমানো তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সকালে, সে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে এবং কথাবার্তা বলার ব্যাপারে উদাসীন হয় পড়ে।
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি বাড়ি থেকে কাজে যাই এবং শিফট শেষ হলে সোজা বাড়ি ফিরে আসি। আমি কখনই অন্য কোথাও যাই না। আমি প্রতিদিন একই রাস্তা দিয়ে যাই, যদি না আমার সাথে আমার সাথে কোনও মেয়ে বন্ধু থাকে। ফেরার সময় অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরি। সেই রাস্তাটা মসজিদের সামনে দিয়ে গেছে। আমি কখনো একা সেখানে যাই না। এলাকার সব খারাপ ছেলে ওই রাস্তায় আড্ডা মারে। আমি যখন আমার বন্ধুর সাথে সেই রাস্তা দিয়ে যাই, ওরা খারাপ মন্তব্য করে। আমি সবসময় ভয় পাই কারণ আমি শুনেছি এই রাস্তাটা মেয়েদের জন্য একদম নিরাপদ নয়। সন্ধ্যার পর, আমি কখনই ওই রাস্তায় যাই না।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
কাকলি তার ফেরার রাস্তায় এক ব্যক্তির মুখোমুখি হয় যিনি মশার হাত থেকে বাঁচবার জন্য ধোঁয়া স্প্রে করছেন। ঘন ধোঁয়ার কারণে রিক্সার গতি কমে যায়, এবং সে রাস্তায় একদল কিশোর ছেলের সম্মুখীন হয়, তাদের মধ্যে একজন তার মুখ ঢাকার কাপড় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, সে হতবাক হয়ে যায় এবং ভয় পায়।
চামড়া বুনে ব্যাগে তৈরি করা হচ্ছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি প্রতিদিন একটা করে কাজ করি। মাঝে মাঝে আমার হাতে ব্যথা হয়, এবং এই মুহূর্তে, আমার সামান্য অস্বস্তি হচ্ছে। আমার কাজ আমার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। যেহেতু এটি আমার কাজ, আমি আজই এটা শেষ করার তীব্র তাগিদ অনুভব করছি, আমি জানি যে কেবলমাত্র তৈরির করার পদ্ধতিতেই আমার দক্ষতা রয়েছে। মাঝে মাঝে একঘেয়ে লাগলেও একটানা কাজ করে যাই।
আমি খুব একটা পানি খাই না। আমাদের বাথরুম নিচের তলায়। আমি তখনই সেখানে যাই যখন না গেলেই নয়। যদিও এটা সবসময় পরিষ্কার থাকে। আমার নিচের তলায় যাওয়া এবং ফিরে আসা, এটুকুই আমার একমাত্র হাঁটার সময়।
গবেষকের অভিজ্ঞতা
কাকলি তার কাজে সৃষ্টিশীল হতে পারে না; এটা তার কাছে একটা একঘেয়েমির কাজ। তবুও সে খুব একাগ্রতার সাথে কাজটা করছে।
বাড়ি এবং কারখানা উভয় ক্ষেত্রেই বাথরুম ব্যবহার করা কমিয়ে দিতে, বাচ্চাদের, বিশেষ করে মেয়েদের, পানি খাওয়া সীমিত করে দিতে দেখা গেছে। এই অভ্যাসে নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের কোনও চিন্তা দেখা যায়নি।
ক্যাফেটেরিয়াতে দুপুরের খাবার খাওয়া
শিশুর অভিজ্ঞতা
ক্যাফেটেরিয়া ব্যবস্থাপনাটি কাকলির মতো কর্মীদের জন্য সুবিধাজনক। যদি তাকে দুপুরের খাবারের জন্য বাড়ি যেতে হত, সে বিশ্রামের সময় পেত না। উপরন্তু, বাড়িতে যেতে এবং কারখানায় ফিরে আসতে তাকে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটতে হত। ক্যাফেটেরিয়াতে সে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কারণ এটা তাকে মনোরঞ্জন করার সুযোগ দেয়।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
ক্যাফেটেরিয়া ব্যবস্থাপনাটি কাকলির মতো কর্মীদের জন্য সুবিধাজনক। যদি তাকে দুপুরের খাবারের জন্য বাড়ি যেতে হত, সে বিশ্রামের সময় পেত না। উপরন্তু, বাড়িতে যেতে এবং কারখানায় ফিরে আসতে তাকে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটতে হত। ক্যাফেটেরিয়াতে সে বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কারণ এটা তাকে মনোরঞ্জন করার সুযোগ দেয়।
সন্ধ্যার জলখাবার এবং চা পরিবেশন করা হচ্ছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি কাজ থেকে ফিরে আরাম বোধ করি। আজ আমাদের বাড়িতে গবেষক এসেছেন শুনে, আমার সহকর্মী বন্ধুরাও আমার সাথে বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে আমরা সবাই মিলে গল্প করে ভালো সময় কাটাতে পারি। আমার মা আপনার এবং আমার বন্ধুদের জন্য সন্ধ্যার জলখাবার এবং চা বানাচ্ছে। বাড়িতে অতিথি থাকলে ভাল লাগে তার কারণ আমি মজা করার বিশেষ সময় সুযোগ পাই না।
আমি আমার ফোনে বিভিন্ন জিনিস দেখা উপভোগ করি। আপু (গবেষক) চলে যাওয়ার পর, আমি বিশ্রাম নিই, TikTok দেখে এবং আমার অনলাইন বন্ধুদের সাথে চ্যাট করে সময় কাটাই। এটাই আমার প্রিয় কাজ, এবং এটা করে আমি খুব আনন্দ পাই। আমি রাত ১১টায় ঘুমাতে যাই।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
দীর্ঘ আট ঘণ্টার কাজের শিফটের পর কাকলি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে প্রতিদিন বিনোদনমূলক কার্যকলাপে যুক্ত হতে পারে না। যাইহোক, আমার উপস্থিতি তাকে কাজের বাইরে তার বন্ধুদের সাথে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয় এবং এটি আমাকেও আনন্দ দেয়। সে সারাদিন বেশি কথা না বললেও, যখন তার বন্ধুরা কারখানা থেকে সোজা তার বাড়িতে আসে তখন তার চোখে আমি আনন্দ দেখতে পাই।