শিশুদের মুখে শোনা তাদের গল্প জীবনের এক দিন

রিনা, ১৪ বছর বয়সী মেয়ে

শিশুদের আসল নাম সুরক্ষিত
১৪ বছর বয়সী মেয়ে রিনা একটা কারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে। সেখানে সে যন্ত্রপাতি চালায় এবং তার নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে তাকে প্রচুর চাপ এবং গালিগালাজ সহ্য করতে হয়। ব্যস্ততার সময়ে সে ভোর ৩টা পর্যন্ত কাজ করে। সে বিপর্যস্ত হয়ে আছে কারণ তাকে এতোটা সময় ধরে কাজ করতে হয়, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে না অথবা কোনও ছুটি পায় না। যেমন, ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য ছুটি নেই। তার হাতে কোনও অবসর সময় থাকে না।

রিনার জীবনের কথা

ঢাকা শহরের বালুরমাঠ এলাকায় একটা পাঁচতলা বাড়ির একটি কামরায় রিনা তার পরিবারের সঙ্গে বাস করে। রিনার সঙ্গে থাকে তার দুই বোন, তার মা এবং বাবা। পরিবারটি মনে করে ঘরটির ভাড়া খুব বেশি হলেও বাস করার পক্ষে এলাকাটি অপেক্ষাকৃত শান্ত। পরিবারের সঙ্গে রিনা ছয় বছর ধরে ঢাকাতে বাস করছে। তাদের পরিবারের অন্যরা তাদের গ্রামের বাড়িতে বাস করেন, সেখানে বাসে যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।

Working late into the night

গভীর রাত পর্যন্ত কাজ হচ্ছে

‘কারখানার ভিতরে খুব গরম। কাজের চাপ খুবই বেশি, পানি খাওয়া তো দূরের কথা, এমনকি গোসলখানাতে যেতেও আমাদের সময় দেওয়া হয় না।‘

Rina’s father collects her from work by rickshaw

রিনার বাবা কাজ থেকে তাকে রিকশা করে নিয়ে আসেন

কাজের পরিস্থিতির জন্য রিনা ঘন ঘন তাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে পারে না। ছুটির অনুমতি পাওয়া কঠিন, এমনকি কোনও আত্মীয় মারা গেলেও ছুটি পাওয়া কঠিন।

তার দাদীর মৃত্যুর খবর পেয়ে সে যখন ছুটি চেয়েছিল তখনও তার নিয়োগকর্তা তাকে ছুটি দেননি। রিনার বাবা রিক্সা চালান। কখনও কখনও তিনি রিনাকে কারখানায় পৌঁছে দিয়ে যান। যদি তার বাবা তাকে কারখানায় নিয়ে যান তাহলে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে। রিনাকে যখন ওভারটাইম কাজ করতে হয় তখন সাধারণত তিনি রিনাকে পৌঁছে দেন আর নিয়ে আসেন। অন্য সময়ে সে বিপদ সংকুল রাস্তা দিয়ে পেটে ক্ষুধা নিয়ে বাড়ি থেকে কারখানায় হেঁটেই যাতায়াত করে, আর দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য মনে চাপ অনুভব করে। সে দেখিয়ে দেয় যে কোথায় দুর্ঘটনা ঘটছে এবং কয়েকটি রাস্তা পার হতে ভয় পায়।

“তারা আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করে, কিন্তু আমাদের সেই অনুপাতে মজুরি দেয় না।

A factory supervisor hitting workers with garments

কারখানার একজন সুপারভাইজার পোশাক দিয়ে শ্রমিকদের মারছেন

যে কারখানায় রিনা কাজ করে তার ভিতরে

রিনা ট্রাউজার তৈরি করার একটা কারখানায় হেল্পারের কাজ করে। তাকে অনেক ধরণের কাজ করতে হয়, এবং তার বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্র চালাতে হয় – কাজটা খুব কঠিন, প্রচুর আওয়াজ হয়, সারা দিন তার হাতে ব্যথা হতে থাকে। সে অত্যন্ত দ্রুত কাজ করতে থাকে এবং কাজে ব্যাঘাত ঘটার মতো কিছু করলে, যেমন কথা বললে, তাকে আটকে রাখা হয়। সে শুধু একদিন মাত্র ছুটি পায় (শুক্রবার)। তাকে সময়মতো মজুরি দেওয়া হয় না, তার অর্থ নিয়োগকর্তার কাছে পাওনা থেকে যায়। তাকে প্রায়ই ওভারটাইম কাজ করতে হয়, কখনও কখনও ভোর ৩টা পর্যন্ত।

কাজের জায়গা ছাড়া রিনা প্রায় কোথাওই যায় না,কখনও কখনও সে বাড়ির জন্য জিনিসপত্র কিনতে এবং তার দিদির বাড়িতে যায়। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানোকে বিশেষভাবে নিরাপদ বলে মনে করা হয় না। নিজের পাড়াতে সে কয়েকটি গলিকে এবং বিনোদনের জায়গাকে যৌন নিগ্রহের কারণে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করে।

The interior of Rina’s home

রিনার বাড়ির অন্দরমহল

আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন বিচলিত বোধ করি। সেই দিন আমি কোথাও যাইনি। আমি শুধু কারখানাতে আর বাড়িতে ছিলাম।

রিনার দিন

০৭.০০
বাড়িতে

শিশুর অভিজ্ঞতা

আমি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠি, আর তারপরে ৭:৪৫ নাগাদ কাজের জায়গার দিকে রওয়ানা দিই। তার আগে আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করি, সে আমাদের বাড়ির সামনেই দাঁত মাজছে। আমার বন্ধুটি একটা জুতার কারখানায় কাজ করে। একটা সরু গলি দিয়ে তার বাড়িতে যেতে হয়। আজ সকালে সে জানত যে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে আসব।

আমি হেঁটে হেঁটে কাজে যাই। তোমার যদি দেরি হয়, তাহলে তুমি বকুনি খাবে এবং তারপরে তোমাকে আগেই চলে যেতে হবে।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

শিশুটি প্রায়ই সকালবেলায় খালি পেটে কাজে যায়।

The exterior of the factory

কারখানার বাইরের দিক

০৮.০০
কাজের সময়

শিশুর অভিজ্ঞতা

আমি বিভিন্ন ধরণের অনেক কাজ করি। এই কারখানাটা খুব ছোট। আমাকে বিভিন্ন ধরণের প্রক্রিয়ায় কাজ করতে হয়, যার মধ্যে থাকে পকেট লাগানো, লেবেল লাগানো এবং যন্ত্র চালানো।

কাজ খুব কঠিন, কোনও কোনও যন্ত্র তো বড়দেরও চালাতে অসুবিধা হয়। আজ সকালে আমি ৮০টা পিস নিয়ে কাজ করছি, আর এই কাজে প্রচুর আওয়াজ হয়। আজ সকালে আমি ৪০০টা ইলাস্টিকের পিস কেটে সিল (পুড়িয়ে) করেছি আর ১০০ পিস রিবন লাগিয়েছি। এই কাজগুলি করতে আমার হাত ব্যথা করে। তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য তারা আমার সাথে চেঁচামেচি করে

তারা সবসময় আমাকে কাজ করেই যেতে বলে, আমাকে এতো কাজ করতে হয় যে আমি গোসলখানায় যাওয়ারও সময় পাই না।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

রিনার অনেক কাজ আছে। ইলাস্টিক লাগানোর মতো কাজগুলি খুব কঠিন।
কারখানার ভিতরে খুব গরম। যন্ত্রগুলো থেকে আওয়াজ হয়, আর তার কাজের উপরে সুপারভাইজারদের প্রচণ্ড চাপ থাকে। প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন না করতে পারলে সবসময়েই চাকরি চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বয়স অল্প হলেও রিনাকে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্র চালাতে হয় – বস্তুত, সে বলে যে বড়রা (প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা) একটি বিশেষ যন্ত্র চালাতে অসুবিধায় পড়েন, এর থেকে বোঝা যায় যে ছোটদের (মেয়েদের) এই কাজটি দেওয়া হয়।

তার দিনের কাজের মধ্যে থাকে ১০০ পিস রিবন লাগানো, রাবারের রিবন কাটা আর জোড়া দেওয়া এবং আগুনের শিখা ব্যবহার করে ৪০০ পিস ইলাস্টিক বানানো। এই কাজটি কঠিন এবং সারা দিনই তার হাতে ব্যথা করে।

আমার কোনও ধারণাই ছিল না যে কারখানার একজন হেলপার এতো কাজ করে। সকাল ৮টা থেকে দুপুরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত রিনা ৭০ জোড়া ট্রাউজারে রাবার লাগায়, ১৫০ জোড়া ট্রাউজারে গিঁট বাঁধে, ২০০ জোড়া ট্রাউজারে চিহ্ন লাগায়, আশি জোড়া ট্রাউজার নিয়ে যন্ত্রে কাজ করে, ২৫০ জোড়া ট্রাউজার ভাঁজ করে আর ৪০০ জোড়া ট্রাউজারের জন্য ইলাস্টিক কাটে।

তার হাতে খুব ব্যথা করছে, এবং এটা স্পষ্ট যে যখন তাকে বারে বারে কাজ করতে বলা হয় তখন তার কতটা খারাপ লাগে। সুপারভাইজাররা তাকে কাজ করার জন্য চিৎকার করে চাপ দিতে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় হল দ্রুত কাজ করার জন্য রিনাকে কতোটা চাপ দেওয়া হয়। মনে হয় তার নিয়োগকর্তারা সময় মতো কর্মীদের মজুরি দেওয়াও এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। ঈদের আগে কারখানায় কোনও ধরণের বোনাস দেওয়া হয় না, যদিও শ্রমিকরা এর জন্য আন্দোলন করছেন। কারখানার কাছে রিনার ৩০০০ BDT (US $২৮) পাওনা আছে।

Outside the factory where Rina works

যে কারখানায় রিনা কাজ করে তার বাইরে

১৩.০০
দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি যাওয়া

শিশুর অভিজ্ঞতা

সকালে আমি কিছু খাইনি, এখন খুব ক্ষুধা লেগেছে। আমি বাড়িতে খেতে যাই আর খাওয়ার পরে আরও শান্তি পাই। খাওয়া হয়ে গেলে তোমাকে সময় মতো কাজে পৌঁছে যেতে হবে। হেঁটে কাজে যাওয়া কঠিন। গরমে আমার ভাল লাগে না।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

রিনা তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। কাজে ফিরে যাওয়ার সময় খুব রোদ ছিল আর গরম লাগছিল। তার সুপারভাইজাররা তার কাজের সময় নিয়ে কঠোর, তাই সে চায় যাতে দেরি না হয়।

A road in Rina's neighbourhood

রিনার এলাকার একটা রাস্তা

২০.০০
বাড়িতে যাওয়া

শিশুর অভিজ্ঞতা

যে (বড়) রাস্তা দিয়ে আমাকে বাড়িতে যেতে হয় সেটা নিরাপদ নয়। এই রাস্তার কাছে যারা থাকেন তারা দুর্ঘটনায় মারা যান। সম্প্রতি এখানে একটা বাইক দুর্ঘটনায় এক বৃদ্ধা মহিলা মারা গিয়েছেন। এই রাস্তাটা পার হতে আমার ভয় করে। রাত ১০টায় রাস্তায় লোক কম থাকে। রাতে যেতে আমার ভয় করে না, কারণ রাতে যাওয়ার সময় আমার বাবা অথবা মা সঙ্গে থাকেন। এলাকাটা আমাদের পরিচিত; আমরা অনেক দিন ধরে এখানে বাস করছি। তবে আমরা এই এলাকায় ঘোরাঘুরি করি না। যখন আমার হাতে সময় থাকে তখন আমি বাড়িতে থাকি, মাকে সাহায্য করি আর টিভি দেখি।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

রিনা খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।

তার বাড়ির কাছাকাছি একটা খেলার মাঠের পাশ দিয়ে আমরা গেলাম। এখন খুব অন্ধকার। অনেকগুলি ছেলে এখানে ঘোরাঘুরি করছে। আমি রিনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ওদের দেখে ভয় করছে কিনা। সে উত্তর দিন যে সে একলা কোথাও যায় না।

Inside Rina’s home

রিনার বাড়ির ভিতরে

২০.৩০
সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে

শিশুর অভিজ্ঞতা

কখনও কখনও আমার মা বলেন যে বাড়ি ফেরার সময় কিছু কিছু জিনিস কিনে আনতে, তাই আমি দোকানে যাই। এ’ছাড়া আমি সাধারণত অন্য কোথাও যাই না।

কাজ শুরু করার পরে আমার একমাত্র ছুটির দিন হল শুক্রবার। আমার একজন বন্ধু আছে। তার বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই, আমি তার বাড়িতে যাই। আমাদের কাছাকাছি কোনও আত্মীয়-স্বজন বাস করেন না। বাসে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যে ৩-৪ ঘণ্টা লাগে। ঈদের ছুটিতে আমরা গ্রামে যাইনি।

মাঝে মাঝে রিক্সা চড়ে সন্ধ্যাবেলা বোনের সঙ্গে আমি তার বাড়িতে যাই। এই এলাকায় ঘুরতে থাকা ছেলেগুলো ভাল নয়। যদি কোনও মেয়ে রাস্তার ধার দিয়ে যায়, তাহলে ওরা বাজে কথা বলে। আমার বোন সেখানে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে থাকে, কারণ তার স্বামী মরিশাসে গিয়েছেন, এবং সম্প্রতি তার একমাত্র সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। খুব শীঘ্রই সে এখানে ফিরে এসে থাকবে।

গবেষকদের অভিজ্ঞতা

কাজ থেকে ফেরার পরে রিনা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে এবং তারপরে বাড়ির কাজ করা শুরু করে।।

রিনার যাত্রা অন্বেষণ