আফতাব, ১৩ বছর বয়সী ছেলে
আফতাবের জীবনের কথা
আফতাব তার পিতা-মাতার সঙ্গে ঢাকা শহরের গজমহলে একটি এক কামরার বাড়িতে বাস করে। তারা একটি ঘনিষ্ঠ পরিবার।
আফতাব হল পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তার বাবা বেকার, আর তার মা সংসার চালান। আফতাব একটা দস্তানার কারখানায় হেল্পারের কাজ করে।
নিজের এলাকা দিয়ে চলাফেরা করতে আফতাব নিরাপদ বোধ করে, কিন্তু তার কারখানায় কয়েকটি যন্ত্র নিয়ে কাজ করা সে মোটেই নিরাপদ মনে করে না।
আফতাবের এক-কামরার বাড়ি
“আমি যদি ভুল করে ইস্তিরিটা ছুঁয়ে ফেলি তাহলে আমার হাত পুড়ে যাবে, আমার একবার এই রকম হয়েছিল। আমার হাতে এখনও পোড়া দাগ আছে।
আফতাবের বাবা যে চামড়ার কারখানায় কাজ করতেন কোভিড অতিমারীর আগে সেটি গজমহল থেকে সরকারের তৈরি করে দেওয়া হেমায়েতপুরের লেদার ডিসট্রিক্টে সরে যাওয়ায় তিনি কাজ হারিয়েছিলেন।
আফতাবের বাবা অন্যান্য কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোনও স্থায়ী চাকরি পাননি। তিনি রিক্সা চালাতে শুরু করেন কিন্তু পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করা তার পক্ষে কঠিন ছিল। আফতাবের স্কুলের ফি ছিল ৬০০ BDT (USD $৫.৫০), যা ছিল একটি বাড়তি বোঝা।
কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে পরিবারটির উপরে আর্থিক চাপ বেড়ে গিয়েছিল, তখন কাজ করার জন্য আফতাব স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।
২০২৩ সালের ৯ই মে তারিখে আফতাব নিজের দিনটা রেকর্ড করেছিল, এতে তার যাত্রা এবং বাড়ির অভিজ্ঞতা, অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে CLARISSA মিটিংয়ে অংশ নেওয়া, কাছের একটা মাঠে যেখানে সে ফুটবল খেলে এবং যে রাস্তাগুলিতে সে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় তা রেকর্ড করা হয়েছিল।
এই দিনটি আফতাবের অন্য দিনগুলির মতো স্বাভাবিক নয়, কারণ CLARISSA মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য সে দিনের শেষ ভাগে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে । মিটিং শেষ হওয়ার পরে সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার, নামাজ পড়ার এবং বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়েছে, যা সে উপভোগ করছে।
“আমার পরিবার যখন আমাকে রোজগার করতে বলেছিল, তখন আমি রাজি হয়েছিলাম আর পরিবারে অর্থ আনতে পারছি।”
আফতাবের মতো শিশুরা বাস করে এমন একটি বাড়ির বাইরের দিক
দস্তানা ইস্তিরি করা
আফতাব কাজ করছে
স্কুল ছাড়ার পরে আফতাব চারটি ভিন্ন ধরণের কাজ করেছে, সবগুলিই চামড়ার জিনিস তৈরি করার কারখানায়। দস্তানা তৈরির কারখানা ছাড়াও সে বেল্ট তৈরি এবং জুতোর কারখানাতেও কাজ করেছে।
আফতাব এখন একজন হেল্পারের কাজ করছে, তাই তার ভূমিকা আর কাজ এক ধরণের নয়। কখনও সে দস্তানা ইস্তিরি করে আবার কখনও একটি যন্ত্র দিয়ে দস্তানা কাটে। এই দুই ধরণের কাজেই ঝুঁকি আছে, আফতাবের দুশ্চিন্তা হল এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতার ফলে তার গুরুতর আঘাত লাগতে পারে, এমনকি একটা হাতও কাটা যেতে পারে।
আফতাব কাজটা পছন্দ করে কারণ তার সব সহকর্মীরাই তার সমবয়সী এবং তারা সবাই খুব কথা বলে। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পেরে সে উত্তেজিত, বৃহস্পতিবারে যা বিরল, এবং তার স্বস্তির কারণ হল যে পরের দিনটি শুক্রবার – সপ্তাহের একমাত্র দিন যেদিন তাকে কাজ করতে হয় না।
“আমি আর পড়াশোনা করতে চাই না; আমি কাজ করে যেতে চাই। আমি যদি এখন পড়াশোনা করতে যাই, তাহলে দেখতে পাব যে আমার বন্ধুরা আমার থেকে দুই বছর এগিয়ে গিয়েছে। আমাকে তাদের জুনিয়ার হিসাবে পড়তে হবে। এখন আমি একটা বড় কারখানায় একটা বড় যন্ত্র চালাতে চাই।”
আফতাবের দিন
আফতাবের বাড়ির সবাইয়ের ব্যবহারের গোসলখানা
শিশুর অভিজ্ঞতা
সকালবেলায় আমার ভাল লাগে। আবহাওয়া খুব ভাল – একটু একটু ঠাণ্ডা এবং সতেজ -, আমার বেশ ভাল লাগছে। আমাকে তাড়াতাড়ি কাজে যেতে হবে, তাই আমি তাড়াতাড়ি উঠেছি আর তৈরি হয়ে নিচ্ছি। আমি গোসল করে খেয়ে নেব তারপর কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হব।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
আজকের আবহাওয়া আফতাবের ভাল লেগেছে। সে সতেজ বোধ করছে এবং দিন শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
তার বাড়িটা অন্ধকার কারণ খুব বেশি জানালা অথবা দরজা নেই যা দিয়ে ঘরে আলো ঢুকতে পারে, শুধু সামান্য বায়ু চলাচল করে।
আফতাব কাজ করছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
কাজে যেতে আর সেখানে গিয়ে চাপ সহ্য করার বিষয়ে আমি কিছুটা চাপে আছি। আমাকে কাজে যেতেই হবে কারণ বাড়িতে আমি পরিবারের একমাত্র সন্তান, বাবা আর মাকে সাহায্য করতে হবে। এইগুলি ভেবে আমার আর খুব খারাপ লাগছে না, কাজে যেতে কিছুটা ভাল লাগছে।
এখানে একতলায় কাজ করতে বেশ ভাল লাগছে। আমি যখন উপরের তলায় কাজ করি তখন কাজের চাপ বেশি থাকে। বেশির ভাগ সময়ে আমার মাথা ব্যথা করে। যেহেতু আমি একজন হেলপার, তাই এক জায়গায় একই কাজ আমার জন্য থাকে না। কখনও কখনও আমি পোশাক ইস্তিরি করতে ব্যস্ত থাকি, কখনও কখনও সেলাইয়ের পরে বেড়িয়ে থাকা বাড়তি সুতো কাটি। যে কাজগুলি আমি নিয়মিত করি তার মধ্যে থাকে যারা কাটার কাজ করে তাদের সহায়তা করা।
এখানে কাজ করতে ভাল লাগে। আমি অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলি, কখনও গান শুনি। আমার ভাল লাগে কারণ এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই আন্তরিক আর প্রচুর কথা বলে। এছাড়াও, এখানে ঝুঁকি কম। উপরের তলাগুলিতে সুপারভাইজার আর ম্যানেজাররা সবসময়েই বলেন যে কাজের সময় আমরা যেন অন্যদের সঙ্গে কথা না বলি।
দুপুর নাগাদ আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। আমার মা বলেন ক্ষুধা পেলে এইরকম হয়। আমার ক্ষুধা পাচ্ছে, তবে আমাকে বেলা ১টার বিরতি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
আফতাব একতলায় কাজ করা পছন্দ করে কারণ কারখানার অন্য অংশগুলির তুলনায় কাজের চাপ এখানে কম থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একতলায় তাকে চামড়া কাটতে হয় না, দস্তানাগুলো কাটার পরে তাকে শুধু সেগুলি গুছিয়ে রাখতে হয়।
আফতাব আরও চারজনের সঙ্গে কাজ করে আর তারা সবাই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে থাকে। তাদের মধ্যে খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে। কোনও ম্যানেজার অথবা সুপারভাইজার থাকেন না তাই তারা বিনা ভয়ে সহজ হয়ে কাজ করতে পারে।
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমার ভাল লাগছে কারণ এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি। বাড়ি গিয়ে খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম করব। আজ কমিউনিটিতে CLARISSA-এর গবেষকদের সঙ্গে একটা মিটিং আছে, তাই আমার একটু বেশি ভাল লাগছে। এই মিটিংগুলোতে যেতে আমার ভাল লাগে।
বাড়ি যেতে যেতে আমার খারাপ লাগছে কারণ এখন আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
লাঞ্চের বিরতির এক ঘণ্টা আগে থেকেই আফতাব অধীর আগ্রহে দুপুরের খাবারের প্রতীক্ষা করে। সে ক্ষুধার্ত। তার জন্য এটা হল দিনের ক্লান্তিকর সময়।
একটি CLARISSA মিটিং চলছে
শিশুর অভিজ্ঞতা
এখানে থাকতে বেশ ভাল লাগে। অনেক কিছু শেখা যায়!
একটা স্বপ্নের বাড়ি কী রকম হতে পারে তা নিয়ে আমরা কথা বলি। আমি বলি যে এর সিঁড়িতে নিরাপদ রেলিং থাকতে হবে, ভাল গোসলখানা থাকবে, প্রচুর আলো-বাতাস থাকবে আর ময়লা ফেলার ডাস্টবিন থাকবে। আমাদের দলে আমরা এইগুলির পরিকল্পনা করছি। এই নিয়ে আমি উত্তেজিত। আমি আমাদের সমাজে পরিবর্তন আনতে চাই। আমরা সবাই ছোট, তাই এতো সবকিছু আমরা একলা হয়তো করতে পারব না, তবে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তন করতে হয়তো দীর্ঘ সময় লাগবে, কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে কাজ করে যাব। প্রথমে আমরা নিজেদের পরিবর্তন করব আর তারপরে অন্যদের।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
আফতাব CLARISSA অ্যাকশন রিসার্চ গ্রুপ মিটিং পছন্দ করে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ সে পছন্দ করে আর পরবর্তী প্রত্যেকটা মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করে। সে নিজের সমাজে অবদান রাখতে চায় এবং ছোটদের জন্য নিরাপদ জায়গা তৈরিতে সহায়তা করতে চায়। মিটিংয়ে থাকার সময়ে সে উদ্যমী, নিজেকে প্রকাশ করে এবং সক্রিয় থাকে।
বিনোদনের এলাকা
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমার ভাল লাগছে কারণ এখন আমি গজমহলের খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছি। এই জায়গাটা আমার কারখানায় যাওয়ার পথে পড়ে, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার অথবা খেলার সময় আমি সাধারণত শুধু শুক্রবারের দিনগুলোতেই পাই।
আমি সবাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে খুব ভাল লাগে। আমরা খেলি আর মজা করি। আগামীকাল যে শুক্রবার তা ভেবে খুব ভাল লাগছে, আর আমার কোনও কাজ নেই। আমি বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে পারি আর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় আফতাব খুব আনন্দিত। প্রত্যেক সপ্তাহে সে মাত্র একদিন ছুটি পায়, সাধারণত শুক্রবার, তাই বৃহস্পতিবার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারা তার জন্য একটা বিরাট ব্যাপার।
শিশুর অভিজ্ঞতা
আমি আমার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই। সন্ধ্যাবেলা নাস্তা আর চা খাই আর বাবা-মায়ের সঙ্গে গল্প করি।
গবেষকদের অভিজ্ঞতা
আফতাব তার বাবা-মায়ের খুব ঘনিষ্ঠ। খেলার মাঠ থেকে ফিরে সে তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে এবং বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, যার থেকে বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধন আছে।